মুখোশ উন্মোচনঃ পর্ব-২
একটা কথাঅনেকের মুখে খুব শোনা যায়, তা হল- “উপমহাদেশে মেয়েরা শালীন পোশাক পরে চলাফেরা করলেও রাস্তাঘাটে ইভটিজিং, হয়রানির শিকার হতে হয়; অথচ পশ্চিমা দেশে মেয়েরা কত খোলামেলা পোশাকে দিব্যি একা একাচলাফেরা করে কোন সমস্যা ছাড়াই। নিশ্চয়ই সমস্যা শুধু আমাদের সমাজের লোকজনেরই, পশ্চিমা দেশগুলো নারীদের জন্য কতইনা নিরাপদ, নারীরা কতই নাস্বাধীন সেখানে...”।
.
এমন অনেকেরইধারণা, ইউরোপ, আমেরিকা নারীদের স্বাধীন চলাফেরার স্বর্গরাজ্য। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া তাদের সমাজকে সকলের সামনে যেভাবে তুলে ধরে তাতে অবশ্য খালি চোখে দেখলে এরকম ধারণা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিশ্বাস করা কষ্টকরহলেও সত্যি, বাস্তব চিত্র এর বিপরীত।পশ্চিমা দেশে নারীরা ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে পুরুষদেরদ্বারা প্রতিনিয়ত যেভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তা আমাদেরসমাজের অবস্থার চেয়ে ভালো কিছু তো নয়ই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরো তীব্র পর্যায়ের। আর পর্ন ইন্ডাস্ট্রিরসূতিকাগার যে সমাজে তারা নারীকেসম্মানের চোখে দেখে নিরাপদ থাকতে দেবে এ আশা করাওতো অবাস্তব। যারা পর্নোগ্রাফিতে নারীকে ভোগ্যবস্তু বানিয়ে পশুর মত ব্যবহার করে, সেসব পুরুষরা রাস্তাঘাটে পরিচিত বা অপরিচিত যেকোন নারীকে দেখে চাইলেওপারে না তাদেরকে স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে সম্মানের চোখে দেখতে।ফলস্বরূপ সেসব দেশে নারীরা রাস্তায়, জনসমাগমপূর্ণ স্থানে, পার্কে, গণপরিবহনে, সবখানে হয়ে চলেছেনচরমভাবে নির্যাতনের শিকার যা খবরের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।আমাদের এই সিরিজের এ পর্বেআমরা তুলে ধরার চেষ্টা করব পাশ্চাত্য সমাজে ঘরের বাইরে নারীদের চলাফেরার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রকৃত চিত্র, যা তথাকথিতমূলধারার মিডিয়া কখনোই আপনাদের কাছে প্রকাশ করবে না।
প্যারিসের গনপরিবহন গুলোতে শতকরা ১০০ জন নারীই যৌন নির্যাতনের শিকার হন। আমেরিকা,কানাডা, ইংল্যান্ডের অবস্থাও ভয়াবহ।
.
একটি নতুনগবেষণায় দেখা গেছে যে, লন্ডনের প্রায় অর্ধেক তরুণী জনসমক্ষে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনেককে এমনকি বাসে এবং ট্রেনেও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।End Violence Against Women (EVAW) নামে একটি সংস্থার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ৩৪ বছরের নিচে ৪১ শতাংশ মহিলাকেই রাস্তায় যৌন হয়রানির শিকার হয়ে হয়েছে। এর মধ্যে ২১ শতাংশ বলেছেন যে, তাদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল মন্তব্য ও অঙ্গভঙ্গি করা হয়েছে এবং ৪ শতাংশ বলেছেন তাদের শরীরে হাত দেওয়া হয়েছে।
.
যারা গণপরিবহনে যাতায়াত করেন তাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরো ভয়াবহ। ১০৪৭ জনের মধ্যে চালানো একটি জরিপের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই বলেছে যে তাদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল মন্তব্য করা হয়েছে। ৫ শতাংশ বলেছেন বাসে এবং ট্রেনে তাদের শরীরে হাত দেওয়া হয়েছে। এই বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশের ফলে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং জাতীয় সরকার যৌন হয়রানির প্রতি আরো কঠোর মনোভাব দেখানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। বিগত বছরগুলো ধরে অনেক ওয়েবসাইট এবং সামাজিক সংগঠনগুলো মেয়েদেরকে উৎসাহিত করে যাচ্ছে তাদের সাথে ঘটা ঘটনাগুলো পুলিশে রিপোর্ট করতে এবং তারা পুলিশকে অপরাধীকে ধরার জন্য আরো প্রচেষ্টা চালানোর জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
এ তো জানা গেল কিছু পরিসংখ্যানিক তথ্য। এখন কয়েকজন ভুক্তভোগীর ভাষ্য শোনা যাক যারা এধরণের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
.
একজন ভুক্তভোগী রোজি ওয়াডে(২০) পেশায় একজন সংগীত চিত্রশিল্পী। বসবাস করেন পুর্ব লন্ডনে। “লন্ডনেআসার পরে আমাকেঅনেকবার হয়রানির শিকারহতে হয়েছে। আমাকেতিনবার আক্রমণ করাহয়েছে। আমাকে ঘরেবা ট্রেনে অনুসরণকরা হয়েছে। আমাকেপাতালরেলে আক্রমণওকরা হয়েছে একবার।” রোজি তার এক দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা দেন এভাবে, “কিছুদিনআগে আমি আক্রান্তহই লিভারপুল স্ট্রিটস্টেশনে। আমার বাসায়আসতে আসতে রাতহয়ে গিয়েছিল।মোটামুটি ১১ টা৩০ বাজে। আমিএকটি ক্যাশ পয়েন্টব্যবহার করছিলাম। হঠাৎএক লোক এগিয়েআসে। তারা আমাকেজিজ্ঞেস করে, ‘তোমারনাম কি?’ আমিক্যাশ পয়েন্টটি থেকেটাকা তুলতে যাইকিন্তু সেটা ছিলআউট অফ অর্ডার।আমি সেখান থেকেসরে আসি। কিন্তুসে আমাকে অনুসরণকরতেই থাকে। আশেপাশেঅনেক মানুষও ছিল।এই অবস্থায় আমিপরিষ্কার করে জানিয়েদেই যে, আমিতার সাথে কথাবলতে ইচ্ছুক না।সে এরপরেও আমাকেঅনুসরণ করতে থাকে।সে তার হাতদিয়ে আমাকে জড়িয়েধরে। সে ‘তোমারকি বয়ফ্রেন্ড আছে’ ‘আমার বাসায় আসতেচাও’ এইরকম নানা কথাজিজ্ঞেস করতে থাকে।আমি ধীরে ধীরেআক্রমণাত্মক হয়েউঠি। এক পর্যায়েসে আমার চুলধরে টান দেয়।আমি চিৎকার করেউঠি।”
.
আরেক ভুক্তভোগীএক্সটারনিবাসী নাটালি জানান, “আমিকয়েকজন বন্ধুরসাথে শুক্রবারকাজ শেষেএকটি ক্যাশপয়েন্টেরলাইনে দাড়িয়েছিলাম।আমি ছিলামশহরের ব্যস্তএকটি এলাকায়।রাতটি অনেকঠান্ডা ছিলতাই আমিএকটি গরমকোট গায়েদিয়েছিলাম। হঠাৎপাঁচজন লোকজগিং করতেকরতে আসছিল।তাদের একজনআমার পিছনেহাত দিয়েজোরে চাপদিল। এততাড়াতাড়ি ঘটনাটাঘটে গেলযে আমিদেখতেই পারিনিতাদের মধ্যেকোনজন এইকাজটি করেছে।আমার নিজেকে তখন খুব অসহায় আরদুর্বল মনেহচ্ছিল।”
.
উত্যক্তকারীরা আক্রমন করলে আপনি যদি তাদেরকে থামতে বলেন তো পরিস্থিতি খুব শীঘ্রইউত্তপ্ত হয়ে উঠে-এক ভুক্তভোগীরমন্তব্য ছিল এমন। “আমরারাস্তার মুলসড়কে ছিলাম।আমি যখনছোট একটারাস্তায় উঠলামতারা আমাকেতিনটা রাস্তাপর্যন্ত অনুসরণকরতে থাকে।আমি তাদেরপিছে ফেলারজন্য দৌড়াতেথাকি। তারাচিৎকার করেনানারকম অশ্লীলকথা বলতেথাকে আমাকেলক্ষ্য করে।আমি খুবইআতঙ্কে ছিলাম।”
.
‘সাউথ লন্ডন রেপ ক্রাইসিস’ থেকে ফিওনাএলভিনস জানান, রাস্তায় কোনপ্রকার যৌন হয়রানিরশিকার হননি এমন মহিলার সাক্ষাত পাওয়া এখন রীতিমত সৌভাগ্যের ব্যাপার। মহিলারা প্রত্যেকদিনই তাদের নিজের রুটিন, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি পরিবর্তন করেন এরজন্য। কিন্তু এটা তাদের আত্মবিশ্বাসে অনেক বড় প্রভাব ফেলেই চলেছে। জানা যায় শুধুমাত্র গত বছরেই লন্ডন পুলিশের কাছে ৪৫০০০টি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আর ৩০০০ টি ধর্ষনের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে!
.
“বাস/ট্রেনেরসীটে কিংবাস্টপেজে আপনিকাউকে নাকাউকে দেখতেপাবেন যেআপনার উদ্দেশ্যেবাজে মন্তব্যকরার জন্যঅপেক্ষা করছে।” মিস গ্রীনএকটি ঘটনার কথা বর্ণনা করেন। এই ঘটনাটা বার্মন্ডসিতে ঘটেছিল। তাকে দুইজনএকটি সাদা ভ্যানে অনুসরণ করছিল যখন তিনি সাইকেল চালাচ্ছিলেন। “তারাআমার উদ্দেশ্যেএমন কথাবলেছিল যে, আমিঅতিষ্ঠ হয়েযাই।”ইউগভ সার্ভে-তে অনেকমহিলা জানিয়েছেন তারা গণপরিবহন ব্যবহারে অনিরাপত্তায় ভোগেন। কেউ কেউ জানিয়েছেন তাদেরকে গন্তব্যের অনেক আগেই ট্রেন থেকে নামতে হয়েছে অথবা বগি পরিবর্তন করতে হয়েছে উত্যক্তকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য। “আমিরাতে যদিএকা বাসায়যাই তোঅনেক আতঙ্কেথাকি। আমিপ্রায়ই ট্রেনেরবগি পরিবর্তনকরি অথবাবাস পরিবর্তনকরি।”এমনটাই ছিল ইউগভসার্ভে-তে মন্তব্যকারীরমতামত।
.
“দোতলাবাসে চলারসময়ে উপরেরতলায় কিছুআপত্তিকর ঘটনাঘটেছে। বিশেষকরে রাতেরবেলা আমিউপরে থাকতেনিরাপদ বোধকরি না।ড্রাইভারের কাছেবসাটাই আমারজন্য নিরাপদমনে হয়।”
.
যৌন নিপীড়নেরশিকারভিকি সিমিস্টার(২৭) একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১০ সালে তিনি কিছু লোকের দ্বারা উত্তর লন্ডনের ম্যানর হাউস আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে আক্রান্ত হন। এরপরে তিনি ইউকে এ্যান্টি স্ট্রিট হ্যারাসমেন্ট ক্যাম্পেইন নামে সংগঠনটি গড়ে তুলেন। তিনি বলেন, “আমি রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম। তখন একটা গাড়িতে করে কিছু মানুষ আমার পাশে ব্রেক করে। তখন অন্ধকার হয়ে আসছিল। তারা আমাকে লক্ষ্য করে আমার পোশাক নিয়ে মন্তব্য করতে পারে।” “তারা গাড়ির গতি কমিয়ে আমি টিউব স্টেশনে যাওয়া পর্যন্ত আমাকে অনুসরণ করতে থাকে। প্রায় পনের মিনিট সময় ধরে এই ঘটনা ঘটে।” “আমি অনেক আঘাত পেয়েছিলাম। আমি তাদের বলেছিলাম আমাকে বিরক্ত না করতে।” “তারা আমাকে স্টেশন পর্যন্ত অনুসরণ করে। তারা আমাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে।”
.
এরকম ঘটনার উদাহরন অসংখ্য। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ও সচেতনতামূলক ওয়েবসাইট গুলোতে প্রতি মাসে হাজার হাজার হিট আসে। তারা তাদের সাথে নিত্যদিন ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো সেখানে শেয়ার করেন। বয়স ১৩ হোক বা ৭০; তারা সকলেই জানতে চান কেন তাদের এসব পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে।
.
এখন মনে কৌতুহল জাগতে পারে, পাশ্চাত্যে নারীরা যদি এতই অনিরাপদ হন তাহলে তা আমাদের কান পর্যন্ত আসে না কেন? কেন আমাদের সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তার অবস্থা আর তাদের সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তার অবস্থাকে কাছাকাছি বলে ধরে নেওয়া হয় না?এর কারণ,পশ্চিমা সমাজের একটা বড় অংশ অশ্লীল মন্তব্য বা অংগভংগি করাকে সাধারণভাবে মেয়েদের ‘আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা’র থেকে বেশি কিছু মনেই করে না। একারণে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে তাদের গড়ে তোলা সামাজিক আন্দোলনগুলোও তেমন পাত্তা পাচ্ছে না। বরং কেউ মুখ খুললে বলা হয় সে বাড়াবাড়ি করছে। আবার সব নারীরা একে খুব একটা ‘হয়রানি’ ভাবেনও না, এমন কেউ কেউ আছেন যারা রাস্তায় কেউ তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কোন আপত্তিকর মন্তব্য করলে এটা উপভোগ করেন! ভাবেন তার রূপের প্রশংসা করা হচ্ছে বা খানিকটা ‘harmless flirting’(!) হচ্ছে। তবে এদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলেও এরা অধিকাংশ নন।
.
আমেরিকা, ইউরোপেরমিডিয়া নিজেদের দেশের নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার এই রূপকখনো উল্লেখ করে না, বরঞ্চ নারী স্বাধীনতারমডেল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে। নিজেদের দেশের নারীদের নিরাপত্তার এমন দশা অথচ অন্য দেশের নারীদের স্বাধীনতার জন্য তাদের হইচইয়ের শেষ নেই।
#ডাবলস্ট্যান্ডার্ড
(লস্ট মডেস্টি অনুবাদ টিম কর্তৃক অনূদিত)
প্রথম পর্বের লিংক-
রেফারেন্স-
[৩] https://ind.pn/2rlBhNt
[৪] https://goo.gl/jx1oB4
[৫] https://goo.gl/rmozJW
[৬] https://goo.gl/fxyhfH
[৭] https://goo.gl/cMXq4k
[৮] https://goo.gl/zVMKkV
[৯] https://goo.gl/HphYfF
[১০]https://goo.gl/b5EvTC
.
[৫] https://goo.gl/rmozJW
[৬] https://goo.gl/fxyhfH
[৭] https://goo.gl/cMXq4k
[৮] https://goo.gl/zVMKkV
[৯] https://goo.gl/HphYfF
[১০]https://goo.gl/b5EvTC
.
.
No comments:
Post a Comment