বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম ।
ফাগুনের দুপুর ।
রাফি সি এনজি থেকে নেমে ঠ্যালাভ্যানে উঠেছে বেশ কিছুক্ষন হল । দেশের বাড়ীতে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে ও । দেশে অবশ্য বহুদিন যায় না সে । এক দূর সম্পর্কের চাচার পরিবার ছাড়া কেউ আর নেইও দেশে । সবাই যে যার মতো ঢাকাতে সেটেল্ড। এতদিন পর সে যে দেশে যাচ্ছে তার কারন তার পাশে বসা আপাদমস্তক বোরখায় মোড়ানো এই মানুষটা; তার স্ত্রী সুমাইয়া । সুমাইয়াকে নিজের দেশ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে সে । মাত্র দু’মাস হলো ওদের বিয়ে হয়েছে । দুজনের ঘোর যে এখনো কাটেনি সেটা বুঝতে তৃতীয়পক্ষের খুব বেশী বেগ পেতে হবেনা । দুজন দুজনার দিকে মাঝে মাঝেই যেভাবে ঘোর লাগা চোখে তাকাচ্ছে,চার চোখ এক হওয়া মাত্রই রাফি তার লাজুক চেহারা ঝট করে ফিরিয়ে নিচ্ছে তা দেখে একটা পিচ্চিও চোখ বন্ধ করে বলে দিবে মিয়া আর বিবির জীবন ফাল্গুনের এই মায়াবী প্রকৃতির মতোই, রঙ্গীন ।

বুড়াভ্যান চালক শামুকের গতিতে ভ্যানটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে । ওদের দুজনের অবশ্য ভালোই লাগছে এতে । দুপুরটা অসম্ভব শান্ত । ১১ কেভি লাইনের ওপরে বসে একটা ঘুঘু তারস্বরে ডেকে দুপুরের এই অপার্থিব নিস্তব্ধতা দূর করার বৃথা চেষ্টা করছে । রাস্তার দুপাশের শিশু গাছ গুলো গার্ড অব অনারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে । বসন্তের লিলুয়া বাতাসে সেই গাছগুলোর পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে রাফি আর সুমাইয়ার ওপর । রাফি মাথার সবুজ টুপিটা ঠিক ঠাক করে নিয়ে আস্তে করে হাত রাখলো সুমাইয়ার মোজা পড়া হাতটার ওপর, সুমাইয়া ঘুরে তাকালো তার দিকে, চার চোখ এক হলো , চোখে চোখে কথা শুরু হল এমন সময় বেরসিকের মতো কাছের একটা গ্রাম থেকে লাউডস্পীকারে চলতি একটা হিন্দি গান বেজে উঠলো । জমাট বাঁধা নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, ঘুঘুটা চমকে উড়ে পালালো । রাফি আর সুমাইয়াও চমকে উঠলো । রাফির হাতের ভেতর থেকে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল সুমাইয়া।
স্বপ্ন ভঙ্গ হলো ওদের । নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ ।
প্রচন্ড বিরক্তিতে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো রাফি । যে ব্যাটা গানটা বাজাচ্ছে তাকে হাতের কাছে পেলে ......
রাফির মনেই পড়লো না একসময় সেও ভরদুপুরে কিংবা গভীর রাতে লাউডস্পীকারে গান ছেড়ে আশেপাশের লোকদের নাভিশ্বাস তুলে ফেলতো । তার জীবনটা এখন কার মতো গোছানো ছিল না। সে ছিল এক বাউন্ডুলে। তেল আর চিরুনির সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল,হাতে বালা । হুমায়ুন গোগ্রাসে গিলতো, হিমু হয়ে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতো রাস্তায় । অষ্টপ্রহর গান শুনত সে । জন ডেনভার,ঈগলস,মান্না দে, হেমন্ত,অঞ্জন দত্ত,আর্টসেল,তাহসান ...... । জীবনের কোন লক্ষ্য ছিল না তার । ভাবতো বন্ধু, আড্ডা,গান, ট্যুর,মাস্তি এই তো জীবন ।
হৈচৈ করে বেড়ানো হাসিখুশী রাফির জীবনে হুট করেই বিশাল একটা বিপর্যয় ঘটে গেল । ফিজিক্সের প্রতীতির প্রেমে পড়েছিল সে প্রথম দেখাতেই । প্রতীতিও । ওদের রিলেশানটা ছিল খুবই গোপন । রাফির বন্ধুবান্ধব কেউই জানতো না ব্যাপারটা।
প্রেম যখন পেকে টসটসে, প্রতীতি রাফির হাতে হাত রেখে ১০৮ বারেরও বেশী জিজ্ঞেস করেছে আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যাবে নাতো , তখন কানাডা থেকে এলো এক দমকা হাওয়া । সেই দমকা হাওয়ায় অচিন দেশের রাজকুমার প্রতীতিকে নিয়ে উড়াল দিল । বিদায় নিতে প্রতীতি, রবীন্দ্র সরোবরের সামনে দেখা করেছিল রাফির সঙ্গে । কেঁদে কেঁদে বলেছিল, “আমাকে ক্ষমা করে দিও,রাফি”। রাফি হেসেছিল । প্রতীতির চোখের পানি মুছে দিয়ে তার দুগালে নিজের দুহাত রেখে বলেছিল, “পাগলি মেয়ে একটা” ।
তারপর কত দিন চলে গেছে । রাফি কত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছে বিছানায় এপাশ করে করে । একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করেছে । গভীর রাতে সাউন্ড সিস্টেম অন করেছে । মান্নাদে কেঁদে কেঁদে জানিয়েছে সে অনেকদিন দেখেনি তার প্রিয়াকে ,তাহসান বলেছে চাঁদের আলো কখনো তার হবে না । মাঝে মাঝে গিটার নিয়ে হলের সিড়িতে বসতো রাফি। গাঁজায় দুটো দম মেরে গান ধরতো ‘গিভ মি সাম সানশাইন , গিম মি সাম রেইন ......’ । খাওয়া দাওয়া করতোনা , ক্লাসে যেত না , ক্লাস টেস্টগুলোও মিস করতো । তার রুমমেট, বন্ধু বান্ধব অনেকেই চেষ্টা করেছে তাকে বোঝানোর । বোঝেনি সে ।
বন্ধুরা সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল । এমন সময় একটা ঘটনা ঘটলো যেটা রাফির জীবনের মোড় ঘুরে ঘুরিয়ে দিল ১৮০ ডিগ্রী ।
গাঁজা আর সিগারেটের গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে তার রুমমটে রুম ছেড়ে চলে গিয়েছিল । বেডটা কয়েকদিন ফাঁকাই পড়েছিল । সেই দিনগুলাতে রাফি আরো বেশী করে গাঁজা টানত । কয়েকদিন পরে সেই বেডে উঠলেন সিভিলের নাফিস ভাই । নাফিস ভাই এর মুখে একগাল দাঁড়ি, চোখে চশমা , ইয়েমেনি এক শায়খের মতো দেখতে অনেকটা । মুখে সব সময় স্মিত হাসি । প্রথম দেখাতেই মানুষটাকে খুব ভালো লেগে গিয়েছিল রাফির । রাফির বেহাল অবস্থায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন উনি ।
ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে রাফিকে বুঝিয়েছেন উনি । রাফি তর্ক করেছে , মেজাজ হারিয়েছে মাঝে মধ্যেই , চিৎকার করে বলেছে , “আমাকে আমার মতোই থাকতে দিন না নাফিস ভাই। আপনারা হুজুর মানুষ , ভালোবাসার কি বোঝেন ?”
ভালোবাসার কি বুঝি! নাফিস ভাই স্মিত হেসে রাফিকে শুনিয়েছেন ভালোবাসার এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান । শুনিয়েছেন মুহাম্মাদ খাদীজার প্রেমের কথা, শত বাঁধা বিপত্তির মুখেও দ্বীন প্রচারে মুহাম্মাদের দৃঢ়তা আর খাদীজার পাশে থাকার কথা । শুনিয়েছেন স্ত্রীর সঙ্গে মুহাম্মাদের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্প, সওয়ারীর পিঠে উঠতে স্ত্রীকে সাহায্য করার জন্য হাঁটু গেড়ে বসে পড়ার গল্প । রাফি শুনেছে আর মুগ্ধ হয়েছে ।
এমনটাও হয়!
আস্তে আস্তে রাফির মধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু হল । ঝাঁকড়া চুলে তেল চিরুনী পড়লো,সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিল ,গাঁজা ছেড়ে দিল একেবারেই, শুক্রবার ছাড়াও মাঝে মাঝে মসজিদে যাওয়া শুরু করলো । প্রতীতির বিরহের মাত্রা হ্রাস পেতে শুরু করলো ।
একদিন নাফিস ভাই রাফিকে শোনালেন আশ্চর্য একদল তরুণীদের কথা ,আয়তনয়না যাদের চোখ, কোন মানুষ ও জ্বীন কখনো যাদের স্পর্শ করেনি । প্রবাল ও পদ্মরাগের মতো এই সব তরুণীদেরকে আল্লাহ্ (সুবঃ) নাম দিয়েছে হূর আল আঈণ । আল্লাহ্ (সুবঃ) এদেরকে নাকি এতো সুন্দর করে বানিয়েছেন যে এদের দিকে তাকিয়েই মানুষ নাকি বছরের পর বছর কাটিয়ে দিবে । তবু চোখ ফেরাতে পারবে না ।
“দেখ রাফি, প্রতীতির চেয়ে হাজার হাজার গুনে সুন্দরী হবেন জান্নাতে তোমার স্ত্রী। প্রতীতি যেমন তোমাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে, জান্নাতের স্ত্রী কখনোই তোমাকে ধোঁকা দিবেন না । প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে আগের মুহূর্তের চেয়েও বেশী ভালোবাসবেন । জান্নাতের স্ত্রীর হাতে হাত রেখে কার্তিকের নরম হলুদ আলোয় তুমি হেঁটে বেড়াতে পারবে ধানক্ষেতের আইল বেয়ে, অশত্থের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসবে তুমি , তোমার স্ত্রী তোমার কাঁধে মাথা রেখে বসবে ঠিক তোমার পাশেই। সব রং নিভে যাবে । থাকবে শুধু অন্ধকার । পাশাপাশি বসবার ।
নাফিস ভাই এরপর রাফিকে দুইটা লিখা (http://bit.ly/2gqcbH8 , http://bit.ly/2khn5xA ) পড়তে দিয়েছিলেন । এই দুইটা লিখা পড়ার পর প্রতীতির প্রতি যা ভালোবাসা ছিল তার এক কানাকড়িও আর থাকলো না রাফির মনে । কঠোর প্রতিজ্ঞা করলো জান্নাতের সেই মুহূর্তগুলো কিছুতেই মিস করা যাবে না । বদলে গেল রাফি । আমূল বদলে গেল ।
দ্বীন নিয়ে সিরিয়াস হবার পর একটা বিষয় খুব ভোগাতো রাফিকে । প্রতীতি যখন ছেড়ে চলে যায় রাফিকে তখন বাস্তবতা থেকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য সে গাঁজা টানতে শুরু করে , সেই সাথে সে ঘন্টার পর ঘন্টা পর্ণমুভি দেখা । নাফিস ভাইয়ের দেখা পাবার আগ পর্যন্ত সে পর্ণমুভির আসক্তি নিয়ে তেমন একটা মাথাঘামাতো না । কিন্তু পরে এই ব্যাপারটাতে সে ভেতর থেকে কুঁকড়ে যেতে থাকে । একদিন ঐ জঘন্য কাজটা করার পর রাফি মসজিদের পিলারের আড়ালে সিজদাহতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিল । সেটা দেখে ফেলেন নাফিস ভাই । তারপর কি করে যেন বুঝে ফেলেন রাফির পর্ণ আসক্তির কথা । একবিকেলে আসরের সলাতের পর রাফিকে নিয়ে মিজান মামার দোকানে যান নাফিস ভাই । লাচ্ছির অর্ডার দিয়ে শুরু করেন কথা .........
(আগামী পর্বে সমাপ্য ইনশা আল্লাহ্ )
পড়ুন আগের পর্বগুলো -
No comments:
Post a Comment