বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম ।
অত্যন্ত সুদর্শন আর হ্যান্ডসাম ছিল সে । লম্বা, ঋজু শরীরের কাঠামো , কোঁকড়ানো চুল, ঈগলের ঠোটের মতো বাঁকানো খাড়া নাক । প্রথম দর্শনে যে কেউই পছন্দ করে বসত , রাজ্যের মায়াভরা চোখ দুটো যে কোন মেয়েরই রাতের ঘুম হারাম করার মতো যথেষ্ট ছিল ।
আইনের তুখোড় ছাত্র ,বিনয়ী নম্র , মার্জিত রুচির পোষাক আশাক সব মিলিয়ে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ।আপাদমস্তক নিপাট ভদ্রলোক ।
![]() |
থিওডর রবার্ট বান্ডি ওরফে টেড বান্ডি |
সুদর্শন চেহারা আর ভদ্রলোকের মুখোশের আড়ালে সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ ছিল সে- যেন রবার্ট লুই স্টিভেন্সনের গল্পের বই থেকে উঠে আসা বাস্তবের ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড । সে ছিল একটা সিরিয়াল কিলার , রেপিস্ট , একটা নরপিশাচ । ৩০ এরও বেশি মেয়েকে সে নিজের হাতে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে খুন করেছিল যদিও বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশী ।
লোকে তাকে টেড বান্ডি বলেই জানতো । শেয়ালের মতো ধূর্ত ছিল সে , বিড়ালের মতো নিঃশব্দ ছিল তার চলাফেরা । খুব নিখুঁত নারী শিকারের প্ল্যান করতো বান্ডি , চিতার ক্ষিপ্রতায় শিকার করে স্রেফ ভূতের মতো মিলিয়ে যেত হাওয়ায় । বাঘা বাঘা পুলিশ অফিসার আর ঝানু ঝানু গোয়েন্দাদের নাকের জল আর চোখের জল এক করে ছেড়েছিল সে । সত্তরের দশকে আমেরিকার ৭ টি প্রদেশ জুড়ে কায়েম করে ফেলেছিল এক ত্রাসের রাজত্ব ।
থিওডর রবার্ট বান্ডি ওরফে টেড বান্ডির জন্ম মার্কিন মুলুকের Burlington এ, , ১৯৪৬ সালের ২৪শে নভেম্বর । বান্ডির বাবা কে ছিল তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ ছিল । বান্ডির মনে সারাজীবন মায়ের প্রতি চাপা একটা ক্ষোভ ছিল এ ব্যাপারটা নিয়ে ।
পড়াশোনাতে বেশ মেধাবীই ছিল টেড বান্ডি ,১৯৭২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করে সে ।
প্রথম আঘাতঃ
ঠিক কখন এবং কোথায় বান্ডি নারী শিকার শুরু করেছিল তা নিয়ে বিস্তর তদন্ত হয়েছে , জল অনেক ঘোলা করা হয়েছে কিন্তু আসল তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি । বান্ডি এক এক সময় এক একজনকে এক এক রকম কথা বলতো ।
ধারনা করা হয় ১৯৬৯ সালে সে মেয়েদের কিডন্যাপ করা শুরু করলেও খুন করা শুরু করে ১৯৭১ সালের পর থেকে ।
কিছু আলামত এবং তদন্ত থেকে অনেক ডিটেক্টিভ আবার ধারনা করেন খুনি হিসেবে বান্ডির আত্মপ্রকাশ আরো অনেক আগে, ১৯৬১ সালে ৮ বছর বয়সের একটা মেয়েকে খুন করার মাধ্যমে - যখন বান্ডির বয়স মাত্র ১৪ । বান্ডি অবশ্য চিরকাল এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে ।
টুকটাক কিডন্যাপিং এবং দু একটা খুন করে হাত পাকানোর পর বান্ডি শুরু করে তার আসল খেলা ১৯৭৪ সালে , ২৭ বছর বয়সে ।
শিকারঃ
বান্ডি টার্গেট করত হাল ফ্যাশনের আকর্ষণীয় পোশাক পড়া সুন্দরী কলেজ,ইউনিভার্সিটির মেয়েদের যাদের বয়স সাধারনত ১৫-২৫ বছর । সুন্দর জামা কাপড় পড়ে কেতাদুরস্ত হয়ে মুখোশ, টর্চ লাইট , দড়ি দাড়া , সিঁধকাঠি , হ্যান্ডকাফ ইত্যাদি বাদামী ভোক্সওয়াগানে চাপিয়ে বান্ডি বেরিয়ে পড়তো শিকারের খোঁজে । টহল দিয়ে বেড়াতো এমন জায়গাগুলোতে যেখানে নারীদের আনাগোনা খুব বেশি । কাউকে মনে ধরলে বা একা একা কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলে নেমে আসতো গাড়ি থেকে ।
এই সেই বাদামী ভোক্সওয়াগান ; টেড বান্ডির অনেক পাপের সাক্ষী |
তার এক হাত ঝোলানে থাকতো স্লিংএ বা এক পায়ে থাকতো প্লাস্টার – ভান করতো যেন তার হাত / পা ভাঙ্গা । আরেক হাতে থাকতো ভারী ব্রিফকেস বা মোটা মোটা বই । টার্গেটের খুব কাছে যেয়ে টার্গেটের মনযোগ আকর্ষণের জন্য বই গুলো সশব্দে ফেলে দিত বা এমন অভিনয় করত যে খুব কষ্ট হচ্ছে তার ব্রিফকেসটা বহন করতে - জরুরী সাহাজ্য দরকার ।
টার্গেট সাহাজ্য করতে আসলে সুদর্শন টেড বান্ডি “শুধু কথা দিয়েই চিড়ে ভিজিয়ে ফেলতো” । অনুরোধ করত বইগুলো গাড়ি পর্যন্ত পৌছে দেওয়ার । বই / ব্রিফকেস নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছানো মাত্রই নরক নেমে আসতো টার্গেটের মাথায় ।
বেশ কয়েকদিন পর অসহায় মেয়েটার বিকৃত ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া জামা কাপড় ছাড়া লাশ পাওয়া যেত কোণ এক পরিত্যাক্ত জায়গায় – পাহাড় পর্বতে বা বনে জংগলে । অনেক সময় লাশের চিহ্নটুকুও পাওয়া যেত না ।
বান্ডি এতোটাই বিকৃত মানসিকতার ছিল যে সে লাশ পচে গলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত লাশের সঙ্গে সেক্স করতো । হয়তো একজায়গায় খুন করে ২০০ মাইল দূরের কোন এলাকায় যেয়ে সে আরেকটা খুন করতো , তারপর আবার প্রথম ক্রাইম স্পটে এসে লাশের ওপর ঝাল মিটাতো – আস্ত শয়তান লোক ।
সিয়াটল , সল্টলেক সিটি , কলারাডো , ফ্লোড়িডার মেয়েরা অদৃশ্য আতংকে ভুগতো , অজানা এক সাইকো ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরে না জানি কখন কার পালা আসে । এক হোস্টেল থেকে আরেক হোস্টেলে যাবার সময় , থিয়েটার বা মুভি থেকে ফেরার পথে এমনকি করিডোর দিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে যাবার সময়ও মেয়েরা গায়েব হয়ে যেত , চিরুনী অভিযান চালিয়েও ধরা যেত না ঘাতককে ।
মাঝে মাঝে টুকটাক চাকুরী করলেও বান্ডির আয়ের একটা বড় উৎস ছিল পকেট কাটা আরো নির্দিষ্ট করে বললে মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ কাটা । হাত সাফাইও ভালো জানতো সে । সুপার স্টোর গুলো থেকে জিনিস পত্র চুরি করার ওস্তাদ লোক ছিল এই বান্ডি ।
একের পর এক মেয়ে রহস্যময় ভাবে গায়েব হয়ে যাচ্ছে অথচ রহস্যের কোন কিনারা হচ্ছে না – ধরা পড়ছে না ঘাতক । king county sheriff office এর ডিটেক্টিভরা আর Seattle Police Department কুত্তা পাগল হয়ে গিয়েছিল অপরাধী ধরার জন্য । কিন্তু বান্ডির শিকারের সংখ্যা কুড়ি পার হবার আগ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারে নি তারা প্রত্যেকেই আসলে পৃথক পৃথক ভাবে একজন লোকের পেছনে ছুটছে ।
এর কারন ছিল অবশ্য – টেড বান্ডির মস্তিষ্ক ছিল ক্ষুরধার, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারার অভাবনীয় ক্ষমতা ছিল তার , ক্রাইম মেথোডোলজি নিয়ে গভীর পড়াশোনা তাকে শিখিয়েছিল কিভাবে কারো সন্দেহের উদ্রেক না করে ক্রাইম স্পটে আঙ্গুলের ছাপ বা এই জাতীয় কোন ক্লু না ফেলে নিমিষেই হাপিশ হওয়া যায় । ছদ্মবেশ ধারন করাতে ওস্তাদ ছিল সে - চুলে দু আঙ্গুল চালিয়ে বা ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান বদলে ফেলে খুব তাড়াতাড়িই নিজের চেহারা বদলে ফেলতে পারত – এ কারনেই কোন প্রত্যক্ষদর্শীই নির্দিষ্ট করে তার চেহারার বিবরন দিতে পারতোনা পুলিশকে ।
ফায়ার আর্মস ব্যবহার করা সে সচেতন ভাবেই এড়িয়ে গিয়েছিল নিজের আইডেন্টিটি লুকানোর জন্য – ব্যবহার করতো বাড়ির টুকুটাকি জিনিস – নাইলনের দড়ি দাড়া , স্টকিং ...
এতো বিশাল এলাকার পরিধিতে অল্প সময়ের ব্যবধানে সে খুন এবং রেপ গুলো করতো যে পুলিশের পক্ষে বোঝা সম্ভব হতো না যে এই সব নারকীয় ঘটনার পেছনে একটা লোকই দায়ী - টেড বাণ্ডি , বান্ডির নিজের ভাষায় - "... the most cold-hearted son of a b***h you'll ever meet ...।
ঠিক কতটা খুন বান্ডি করেছিল তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না – ৩০ টি খুনের ঘটনা সে নিজে স্বীকার করেছে । কিন্তু বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দেয় তার খুনের সংখ্যা প্রায় একশোর কাছাকাছি । টেড বান্ডির আইনজীবিও একসময় স্বীকার করেছিল টেড একশোর বেশী হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ।
কি ছিল টেড বান্ডির এই অন্ধকার জগতের চালিকা শক্তি ? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ডিগ্রীও টেড বান্ডিকে মানুশ বানাতে পারেনি ? টেড বান্ডির শেষ পরিনতিই বা কি ছিল ?
সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সিরিয়াল কিলার সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে (http://lostmodesty.blogspot.com/2016/04/blog-post_22.html ) ইনশা আল্লাহ
.........
তথ্য সূত্র- ইন্টারনেট
No comments:
Post a Comment