প্রথম পরিচয়
ক্লাস নাইন টেনের সময়টাতে গান শোনার প্রচন্ড নেশা ছিল। স্কুল আর ঘুমানোর সময় বাদ দিয়ে প্রায় পুরোটা সময় একটার পর একটা গান শুনতাম। গান শোনা ছাড়া কেন জানি থাকতে পারতাম না। সে সময় আমার নিজের পিসি বা ফোন কিছুই ছিল না। গান শোনার একমাত্র সম্বল ছিল সনির এমপি ফাইভ। তখনো এন্ড্রয়েড ফোনের যুগ শুরু হয়নি। বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নকিয়া ২৭০০ ক্লাসিক আর চায়না ফোন। বন্ধুদের চায়না ফোনের লাউডস্পীকার থেকে তাহসানের গান ভেসে আসতো, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম আর ভাবতাম কবে আমি একটা এরকম “অস্থির” ফোনের গর্বিত মালিক হবো।
সারাক্ষণ যেহেতু গান শুনতাম তাই একটা গানে অল্প দিনেই অরুচি ধরে যেত। ইন্টারনেট তখন আমার কাছে স্বপ্নের মতো। গলির মোড়ের কম্পিউটারের দোকানই ভরসা। কয়েকদিন পর পর গলির মোড়ের কম্পিউটারের দোকানে যেতে হতো নতুন গান ডাউনলোড দিতে। দশ বিশ টাকা দিলেই পুরো এমপি ফাইভ ভর্তি করে গান দিয়ে দিতো। এভাবে বার বার যাবার কারণে দোকানদারের সাথেও বেশ খাতির জমে গেল। তো একবার সে লোক আমার এমপি ফাইভ লোড করে দিয়ে একটু বেশী টাকা চাইলো। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে একটা চোখ টিপ দিয়ে বললো, “মাল দিছি ছোট ভাই”।
পরে আমার অনেক বন্ধুবান্ধবের কাছে অনেকটা একইরকমের গল্প শুনেছি। কেউ দোকানে গেছে কলকাতার বাংলা সিনেমা ডাউনলোড করে নিতে, কম্পিউটারের দোকানদার সেই সিনেমা তো দিয়েছেই সেই সাথে ফাউ হিসেবে কিছু নীল সিনেমাও দিয়ে দিয়েছে। তারপর আস্তে তাকে পর্ন ভিডিওতে আসক্ত বানিয়ে ফেলে দোকানের ক্যাশ বাক্স ভরিয়েছে। আমার খুব কাছের অসম্ভব মেধাবী একজন বন্ধু এভাবে পর্ন ভিডিওতে আসক্ত হয়ে পড়াশোনা শিকেয় তুলে ফেলেছিল। খুব কাছ থেকে পর্নোগ্রাফির মুভির কারণে ওর বদলে যাওয়া দেখেছি। এই হাইস্পিড ইন্টারনেটের যুগেও প্রতিনিয়ত অনেককে দেখি এভাবে কম্পিউটারের দোকান থেকে মেমোরি কার্ড লোড করে নিতে (বিশেষ করে গ্রাম এবং মফস্বল অঞ্চলগুলোতে)। পঞ্চাশ-ষাট টাকার জন্য জাহান্নাম কিনে নিতে দুবারও ভাবছেন না এ সব দোকানদাররা।
“যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না”। [২৪:১৯]
পর্ন ভিডিওর সাথে পরিচয়ের আরেকটা কমন মাধ্যম হচ্ছে কচি বয়সেই “পেকে” যাওয়া বন্ধু বান্ধব। এই অকালপক্ক বন্ধু বান্ধবের দল কোন ভাবে পর্নমুভির সন্ধান পেয়ে গেছে। তারপর তারা নিজেরা তো সেই জিনিস দেখেই সাথে সাথে তার ইয়ার দোস্তকেও সেটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মহান দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। শেয়ার ইট, ব্লু টুথ, পেনড্রাইভ, হার্ডডিস্কে চলে লেনাদেনা। ক্লাসের গোলগাল মোটা রিমের চশমা পড়া ভদ্র ছেলেটাকেও জোরাজুরি করে পর্ন ভিডিও দেখার জন্য। বন্ধুদের চাপাচাপিতে নেহায়েত বাধ্য হয়েই ভদ্র, ভালো ছেলেটা হয়তো একবার পর্ন ভিডিও দেখে ফেলে। প্রথমবার দেখে তার বমি আসতে চাইলেও, পাসশাপাশি শরীরে অচেনা এক “ফিলিংস”-ও কাজ করে। পরে আবার দেখতে ইচ্ছে করে। তারপর আবার। এভাবেই একসময় ভালো ছেলেটাও আটকা পড়ে পর্ন মুভির জালে।
অনেক সময় ১০-১২ বছরের ছেলেরা শরীরে হুট করে আসা পরিবর্তন দেখে চমকে যায়, কিন্তু ভয়ে বা লজ্জায় বাবা মাকে এগুলো সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করতে পারে না। কৌতূহল মেটাতে না পেরে বাধ্য হয়ে শেষমেষ আশ্রয় নেয় তাদের বন্ধুদের কাছে। বন্ধুদের সাথে এ কথা, এই আলোচনা সেই আলোচনা হতে হতে একসময় পর্ন, মাস্টারবেশন এই কথাগুলও চলে আসে। এভাবেও অনেকের পর্ন এবং মাস্টারবেশনের সাথে পরিচয় হয়ে যায়। আমার বাল্যকালের অনেক ইয়ার দোস্তদের এভাবেই পর্ন এবং মাস্টারবেশনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।
পর্নমুভির সঙ্গে পরিচয় ঘটার আর একটা মাধ্যম হচ্ছে বড়ভাই, কাযিন বা পাড়াতো ভাই বোনদের (বিশেষ করে গ্রামে এটা খুবই বেশী) পর্ন আসক্তি। বড়ভাই, বোন বা কাযিন পর্ন ভিডিওতে আসক্ত। তার মোবাইলে বা পিসির মেমোরি ভর্তি পর্ন ভিডিও। ছোটভাই, বোন বা কাযিন সে মোবাইল বা পিসিতে মাঝে মাঝে গেইমস খেলে, ঘাঁটাঘাঁটি করে। হুট করে সে একদিন আবিষ্কার করে বসবে পর্ন ভিডিও। আমার খুব কাছের একজন আত্মীয়ের ছয় সাত বছরের পিচ্চির এভাবেই পর্নোগ্রাফির সাথে পরিচয় ঘটে গেছে।
কথাটা বলতে খুব খারাপ লাগছে কিন্তু তবুও বলি, এভাবে পাড়াতো ভাই বোন বা কাযিনদের মাধ্যমে যেসব বাচ্চাদের পর্নোগ্রাফির সাথে পরিচয় ঘটে, সেই পাড়াতো ভাই বোন বা কাযিনদের মাধ্যমে সেই বাচ্চাদের যৌন নিপীড়িত হবার খুব ভালো একটা সম্ভাবনা থাকে।[1] কাজেই এটা খুবই সিরিয়াসলি নেয়া দরকার।
তবে পর্নোগ্রাফি এবং মাস্টারবেশনের সাথে টিনেইজার বা বাচ্চাদের পরিচিত হবার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট চ্যানেল। অ্যামেরিকাতে শতকরা ৪৬ ভাগ কিশোর নেট ব্রাউযিং করা অবস্থায় নিজেরা পর্নোগ্রাফি না খুজলেও এমনি এমনিই পর্ন ভিডিওর খোঁজ পেয়ে যায়।[2] ১৫-১৭ বছর বয়সী টিনেইজারদের মধ্যে শতকরা ৭০ জন অনলাইনে স্বাস্থ্য বিষয়ক কন্টেন্ট ঘাটতে গিয়ে হুট করে পর্ন ভিডিওর সন্ধান পেয়ে যায়।[3]
তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে আপনার সন্তানকে একদিন না একদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিতেই হবে। আমরা সেটা নিষেধও করছি না। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, আপনি ১০-১২ বছরের একটা বাচ্চার হাতে কেন হাই স্পিড নেট তুলে দেবেন? কেন তাদের হাই কনফিয়াগেরশান ফোন তুলে দেবেন? ১০-১২ বছরের একটা বাচ্চা হাই কনফিগারেশান ফোন, হাই স্পিড নেট দিয়ে কী এমন গুরুত্বপূর্ন কাজ করবে ঠিক বুঝতে পারছি না? সে কি নেট ঘেঁটে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার ব্যাপারে গবেষণা করবে? ইউটিউব থেকে টিউটোরিয়াল নামিয়ে দেখবে? উইকিপিডিয়াতে গিয়ে পড়াশোনা করবে? গুগলে বিভিন্ন শিক্ষামূলক বিষয় নিয়ে সার্চ করবে? ফেইসবুকে বিভিন্ন শিক্ষামূলক গ্রুপে থাকবে?
বি প্র্যাক্টিকাল। আপনার সন্তান গুগলে ঠিকই যাবে তবে “সালোক সংশ্লেষণ” নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্য না, পর্ন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্য। ইউটিউব থেকে টিউটোরিয়াল নামাবে না, নামাবে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত পর্দায় “আগুন লাগানো” কোন আইটেম সং। ফেইসবুকের শিক্ষা মূলক গ্রুপ গুলোতে তাকে খুবই কম পাওয়া যাবে, সে বুঁদ হয়ে থাকবে কারো রঙ্গ লীলার কাহিনীতে কিংবা সময় কাটাবে বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে চ্যাট করে।
আপনার সন্তানকে কি ফেরেশতা ভাবেন? সে কি মানুষ নয়? তার কি জৈবিক চাহিদা বলে কিছু নেই? পত্রিকা, বিলবোর্ড, টিভি, সিনেমা, ইন্টারনেট – তার প্রতি চারদিক থেকে ছুড়ে দেয়া হচ্ছে যৌনায়িত ইমেজারি। আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে একসাথে ড্রয়িংরুমে বসে বসে ভারতীয় নর্তকীর নাচ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন, দেখছেন আইপিএল-বিপিএলের চিয়ারলিডারদের শরীরের ভাঁজ, মুভি দেখছেন, বাসায় প্রথম আলো টাইপ পত্রিকা রাখছেন যেটা পর্নস্টার, নর্তকী আর পতিতাদেরকে বাংলাদেশের মানুষজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মহান দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছে। এখনকার বলিউডের এক একটা আইটেম সং পর্ন ভিডিওর চেয়েও খারাপ। নারী পুরুষের সব রসায়নই সেখানে দেখানো হচ্ছে। আপনার সন্তান এগুলো দেখছে, হয়তো আপনার সাথে এক সাথে বসেই দেখছে কিন্তু আপনি তাকে কিছুই বলেন না। এখন কোন আইটেম সং তার ভালো লেগে গেলে সে সেটা ডাউনলোড করার জন্য নেটে তো ঘুরে বেড়াবেই। সেই আইটেম গার্ল এর নাম লিখে গুগল সার্চ তো করবেই। আর এসব জায়গা থেকেই সে খোঁজ পেয়ে যাবে পর্নোগ্রাফির জগতের। আর বীর বাঙালি গুগলের এমন অবস্থা করে ছেড়েছে যে গুগলে কোন বাংলা ওয়ার্ড লিখে সার্চ দিলেই অমুকের স্ক্যান্ডাল, তমুকের রাতের আঁধারে ধর্ষণ, এ জাতীয় খবরের লিংক চলে আসে।
আপনার সন্তান এমন এক সমাজে, এমন এক পরিবেশে আছে যেখানে প্রতিনিয়ত তার জৈবিক চাহিদাকে উস্কে দেয়া হচ্ছে। আপনার সামনেই সেটা হচ্ছে, আপনি এ নিয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, আপনার সন্তানকে এ যৌনতা তাড়িত সংস্কৃতি থেকে রক্ষার জন্য কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না – সে তো আগুন নেভানোর রাস্তা খুঁজবেই।
পরের বার টিভিতে যখন কোন আইটেম সং চলবে, একটা ছোট পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। অন্যান্য বারের মতো অন্যমনস্ক ভাবে চ্যানেল স্কিপ করে যাবেন না। ভালো করে খেয়াল করবেন। একটা ১০-১২ বছরের ছেলে কিংবা মেয়ের চোখে ভিডিওর প্রতিটি ফ্রেম দেখার চেষ্টা করবেন। গানের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনবেন। এধরণের ডজন ডজন বা শতো শতো আইটেম সং বর্তমান সমাজ ও সংস্কৃতিতে একটা ১০-২ বছরের কিংবা আরো ছোট ছেলে অথবা মেয়ের চিন্তা ও আচরণের ওপর ঠিক কী ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেস্টা করে দেখুন। আশা করি সত্য অনুধাবনে কষ্ট হবে না।
এ আইটেম সং গুলো পর্ন আসক্তি তৈরি করে চলেছে। পর্নোগ্রাফির সাথে বাচ্চাদের পরিচয় হচ্ছে হয়তো ১০ -১২ বছর বয়সে, গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে বাচ্চারা এগুলো দেখছে। কিন্তু আপনি নিজেই সারাদিন টিভি ছেড়ে রেখে, খাওয়ানোর সময় বলিউডের গান ছেড়ে রেখে, একেবারে ছোট ছোট শিশুকে আইটেম সং এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই পর্নোগ্রাফির চেয়েও বেশী উত্তেজক ভাবে নারী পুরুষের রসায়ন দেখানো হচ্ছে। মাঝে মাঝে বাজারের কোন ‘হিট’ গান ছেড়ে ওকে বলছেন, “বাবু! একটু নেচে দেখাওতো” বা “বাবু একটু গেয়ে শোনাও তো”। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, নিজ হাতে আপনি ওর কত বড় সর্বনাশ করছেন?
No comments:
Post a Comment