Saturday, July 8, 2017

বিয়ে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে...

বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম

এখনকার মুসলিম তরুণদেরকে বিয়ের ব্যাপারে খুব উদাসীন দেখা যায়। ফলে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা নিয়েই পড়ে থাকে অনেকে। সমাজে প্রচলিত বিয়ের সাথে যে ইসলামী বিয়ের আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে তা অনেকেরই জানার সুযোগ হয় না। এই লেখাটি মূলত তাদের জন্য।
.
বিয়ে কেন করবে?
.
বিয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এমনকি বিয়েকে ‘দ্বীনের অর্ধেক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমেই নারী-পুরুষের মধ্যে হালাল সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটা পরিবার গঠনের উপায়, সভ্যতা টিকিয়ে রাখার উপায়, মানবজাতির বংশরক্ষার উপায়। এটি চরিত্র রক্ষার উপায়, নিজের যৌন চাহিদাকে বৈধভাবে মেটানোর উপায়।
.
যুবকরা খুব সহজেই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে, গান-বাজনায় সময় কাটায়, অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ে। প্রেমে পড়া তো একরকম ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। হস্তমৈথুনও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এগুলোর প্রতিটিই মারাত্মক গুনাহর কাজ। আর এই গুনাহগুলোর মাত্রা বেড়ে যাবার পেছনে অন্যতম কারণ হলো সময়মতো বিয়ে না করা। যুবকদের বয়সটায় বিয়ের চাহিদা থাকা খুবই স্বাভাবিক, বরং না থাকাটাই অস্বাভাবিক। সুতরাং গুনাহ থেকে বাঁচতে চাইলে বিয়ের বিকল্প নেই।


.
তুমি কি বিয়ের উপযুক্ত?
.
আমরা বিয়ের বয়সের ব্যাপারে খুবই ভুল ধারণার মধ্যে আছি। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে, অথচ বিয়ের চিন্তাকে গুরুত্বই দিচ্ছে না- এমন উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। অনেকে লাখ টাকা উপার্জনের আগে বিয়ের কথা ভাবতে পারছে না। পাত্রীর অভিভাবকরা পাত্রের বেতন, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, পৈতৃক সম্পত্তি- সব দেখছেন। মোটা অঙ্কের মোহর ধার্য করা হচ্ছে। ফলে বিয়ে হয়ে পড়েছে কঠিন। ইসলামে বিয়ে কি এত কঠিন?
.
না। ইসলামে বিয়ে খুবই সহজ। ইসলাম বিয়ের জন্য এত কঠিন শর্ত দেয়নি। তবে কিছু শর্ত তো অবশ্যই দিয়েছে। সেগুলো নিয়েই আলোচনা করা যাক।
.
প্রথমত, শারীরিক ও যৌন সক্ষমতা। তুমি সেদিনই বালেগ(প্রাপ্তবয়স্ক) হয়েছ, যেদিন তোমার প্রথম স্বপ্নদোষ ঘটেছে। এখন তোমার বিয়ের জন্য ত্রিশ বছর বয়স হওয়ার কোনো দরকার আছে কি? বিশ-বাইশ বছর বয়স থেকেই তোমার বিয়ের চাহিদা অনুভূত হবার কথা। চাহিদা অনুভূত হবার পরও দেরি করা মানে তোমার ওপর কষ্ট চাপিয়ে দেয়া। ইসলামে বিয়ের কোনো ধরাবাঁধা বয়স নেই। তবে হ্যাঁ, স্ত্রীর যৌন অধিকার তাকে দিতে হবে। এটা স্বামীর দায়িত্ব। সুতরাং বয়সটা মূল ব্যাপার নয়, যৌন সুস্থতাই হলো বিয়ের পূর্বশর্ত। 
.
দ্বিতীয়ত, আর্থিক ক্ষমতা। তুমি তোমার ছোটবোনের কথাই চিন্তা কর। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করতে পারবে না এমন কোনো ছেলের সাথে তুমি নিশ্চয়ই তাকে বিয়ে দিতে চাইবে না। স্ত্রীর যাবতীয় ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। সুতরাং আর্থিক ক্ষমতা থাকাটাও বিয়ের শর্ত।
.
কিন্তু কথা হলো, আর্থিক ক্ষমতা মানে কী? আর্থিক ক্ষমতা বলতে আমাদের সমাজ বোঝাতে চায় যে, বেশি বেতনের চাকরি করতে হবে, গাড়ি থাকতে হবে, বাড়ি থাকতে হবে ইত্যাদি। ইসলামে আর্থিক ক্ষমতা বলতে সেটা বোঝায় না। তুমি তোমার স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে- এটুকুই যথেষ্ট। সে হিসেবে ছোট-খাটো কোনো চাকরি বা ব্যবসাই আর্থিক ক্ষমতার শর্ত পূরণ করতে পারে। থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে; তার জন্য তোমার সামর্থ্যের মধ্যে সাধারণ বাড়িই যথেষ্ট। খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে; কিন্তু সে নিশ্চয়ই রাক্ষসের মতো খাবে না। মৌলিক চাহিদা মেটানোই যথেষ্ট। বিলাসিতার সুযোগ নেই।
.
আল্লাহ তাআলা অভাবগ্রস্তদের বিয়ের মাধ্যমে অভাব দূর করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাছাড়া সবার রিযক্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। কেউ তার চেয়ে বেশি পাবে না, কেউ তার চেয়ে কমও পাবে না। যার জন্য যেটুকু নির্ধারিত আছে সেটুকুই সে পাবে। সুতরাং তোমার স্ত্রী এসে তোমার খাবারে ভাগ বসাবে না। তার রিযক্ব তার জন্যই। বিয়ের আগে তাকে যিনি খাবার দিয়েছেন, বিয়ের পরও তিনিই দেবেন। আমাদের উচিত আল্লাহর ওপরই ভরসা করা।
.
বিয়ের মোহর কম হওয়া ভালো। এতে বিয়েতে বরকত থাকে। সুতরাং পাত্রীপক্ষের উচিত হবে পাত্রপক্ষের সামর্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে কম মোহর চাওয়া। তবে পাত্রীর সম্মান ও অধিকার যেন রক্ষা করা হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। কাজেই সামর্থ্য থাকলে বেশি দিতেও দোষ নেই। ইসলামে মোহরের কোন ঊর্ব্ধসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। আর হ্যাঁ, মোহরের পুরোটাই বিয়ের সময় নগদ পরিশোধ করে ফেলা উচিত, বাকি না রাখাই ভালো।  
.
বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচের কথাটাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে যতো রকমের আনুষ্ঠানিকতা করা হচ্ছে তাতে বিয়ে করতে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এসব অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন হাজারো গুনাহর কাজ হয়, অন্যদিকে তেমন অতিরিক্ত খরচ হয়। এসমস্ত বাজে খরচের কোনো দরকার নেই। অনর্থক খরচের কাজগুলো বাদ দিলেই দেখবে, বিয়ে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। কেবলমাত্র ওয়ালিমা করবে। সেখানে সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করবে।    
.
ভরণ-পোষণের জন্য শুধু আর্থিকভাবে সমর্থ হলেই চলবে না, সকল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও তোমাকে নিতে হবে। যদিও মৌলিক চাহিদা মেটানোর মধ্যেই ব্যাপারটা চলে এসেছে, তবুও একটু বিশেষভাবে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
.
তোমার স্ত্রী যেন ঠিকমতো দ্বীন পালন করতে পারে তা তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে। তাকে সময়মতো নামায পড়ার সময়-সুযোগ দিতে হবে। সে যেন পরিপূর্ণভাবে পর্দা রক্ষা করে চলতে পারে সে ব্যবস্থাও তোমাকেই করে দিতে হবে। বস্তুত, যৌথ পরিবারে থেকে পর্দা রক্ষা করে চলা খুবই কঠিন। [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শ্বশুরবাড়ির মধ্যে শ্বশুর, নানা-শ্বশুর, দাদা-শ্বশুর প্রমুখ ব্যক্তির সাথে দেখা করা ও কথা বলা মেয়েদের জন্য জায়েজ। কিন্তু দেবরের সাথে, ভাশুরের সাথে, ননদের স্বামীর সাথে কিংবা দেবরের ও ননদের  প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সাথে দেখা করা নিষিদ্ধ এবং অপ্রয়োজনে কথা বলাও নিষিদ্ধ; প্রয়োজনে কথা বলতে হলে পর্দা রক্ষা করে বলতে হবে।]  
.
স্ত্রীর অধিকারের প্রতি ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তার যেন কোনো সমস্যা না হয় তা তোমাকে নিশ্চিত করতে হবে। তার দায়িত্বের অতিরিক্ত কিছু তার ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কোনোভাবে তার প্রতি যুলম করা যাবে না। পরিবারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তার অধিকারের লঙ্ঘন করা যাবে না। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি কী কী দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে তা আলিমদের কাছে জেনে নেবে।
.
বিয়ের জন্য আরেকটা যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে। তা হলো কর্তৃত্ব। তোমার স্ত্রীর অভিভাবক তুমি। তার পাপের জন্য তোমাকেও দায়ী থাকতে হবে। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ নারীদের অশ্লীলতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, তার জন্য জান্নাতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং তোমার স্ত্রীর পর্দাহীনতাসহ যেকোনো পাপ কাজের ব্যাপারে তোমাকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
আর্থিকভাবে যতই সামর্থ্য থাকুক, দ্বীন পালনের এই সুযোগগুলো যতদিন তুমি দিতে না পারছ, ততদিন তোমার জন্য বিয়ে না করাই ভালো।
.
কেমন পাত্রী পছন্দ করবে?
.
অবশ্যই দ্বীনদার পাত্রী। যেকোনো বাধা  অতিক্রম করে একমাত্র আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করতে যে মেয়ে সচেষ্ট, তাকেই বিয়ে করবে। এর বাইরে সৌন্দর্য, বংশ মর্যাদা কিংবা সম্পদ দেখতে চাইলে তার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু প্রাধান্য দিতে হবে দ্বীনদারিকেই। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। দ্বীন ঠিকমতো পেলে প্রয়োজনে অন্যগুলোতে ছাড় দিতে হবে।
সামর্থ্য হবার পর বিয়েতে দেরি করলে কি সমস্যা আছে?
.
তোমার গুনাহর আশঙ্কা না থাকলে হয়তো সমস্যা নেই। কিন্তু গুনাহর আশঙ্কা থাকলে সামর্থ্য হওয়ামাত্র বিয়ে করা আবশ্যক। এই ফিতনার যুগে গুনাহর আশঙ্কা আমাদের সবার মধ্যেই আছে। তুমি যতবার কোনো (গায়রে মাহরাম) মেয়ের দিকে তাকাবে, ততবার চোখের ব্যভিচার হবে। যতবার তার সাথে কথা বলবে, ততবার জিহ্বার ব্যভিচার হবে। গার্লফ্রেন্ড থাকলে তো সমস্যাটা আরো মারাত্মক। এসবের কোনো একটার আশঙ্কা থাকলেই বুঝতে হবে, সামর্থ্য হওয়ামাত্র বিয়ে করা আবশ্যক। এছাড়াও পর্নোগ্রাফি, হস্তমৈথুন কিংবা ব্যভিচারের আশঙ্কা থাকলেও বিয়ে করা আবশ্যক।
তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। বিয়ে করামাত্র ম্যাজিকের মতো সব গুনাহ ছেড়ে দিতে পারবে এমনটা ভাববে না। বরং তোমাকে এখন থেকেই গুনাহ ছেড়ে দেবার সঙ্কল্প করতে হবে। বিয়ের আগেও কোনো গুনাহর কাজ করা যাবে না, বিয়ের পরও করা যাবে না। বিয়ের উপকারিতা কেবল এতটুকু যে, বিয়ের মাধ্যমে গুনাহ ছেড়ে দেয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তুমি যদি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে বিয়ে তোমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু তুমি গুনাহ ছেড়ে দেবার ব্যাপারে দৃঢ় সঙ্কল্প না করলে বিয়ের সুফল পাবে না। 
.
এখন তুমি কী করবে?
.
মা-বাবাকে সাধ্যমতো বিয়ের গুরুত্ব বোঝাও। ধৈর্য ধর। নিজের ফরজ-ওয়াজিবগুলো ঠিকমতো পালন কর। নিজে গুনাহ থেকে বেঁচে থাক। তাহাজ্জুদ পড়। নফল সাওম পালন করুন। আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করতে থাক। স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে এবং দ্বীন পালনের সুযোগ দিতে যেন পার সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু কর। বিয়ের ব্যাপারে আলিমদের লেখা বইপত্র পড় এবং তাদের কাছে পরামর্শ নাও। সর্বোপরি, আল্লাহর কাছে সবসময় দুআ করতে থাক এবং সাহায্য চাইতে থাক।
.
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সময়মতো দ্বীনদার স্ত্রী দান করুন, তাদেরকে আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দিন এবং আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কগুলোকে জান্নাত পর্যন্ত স্থায়ী করে দিন। আমীন।
 ===========
লেখকঃ তৌহিদি তিয়াস
============
পড়া যেতে পারেঃ 
কেন বিয়ে মাস্টারবেশনের সম্পূর্ণ সমাধান না: https://goo.gl/poY4mT 

Wednesday, July 5, 2017

‘জার্নি টু ম্যানহুড’

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম।

এবার ঈদে সমকামিতা নিয়ে নাটক বানানো হয়েছে। বেশ ক' বছর থেকে হঠাৎ করেই আমাদের সমাজে সমকামিতার মত একটা জঘন্য অন্যায়কে জোর করে টেনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সমকামিতা একটা ন্যাচারাল বিষয়, সমকামীদেরকে সমর্থন করতে হবে। এক অমুসলিম সমকামী লোকের লেখা পড়েছিলাম অনেক দিন আগে, সে সমকামিতা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তার লেখাটাই অনুবাদ করে দিলাম। তার সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকতে পারে, তবে "গে" হওয়া যে কোনো ন্যাচারাল বিষয় না, আর গে থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যায়, সেটাই এই লেখা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়।
---

"আমার মনে হয়, আমি দুর্ঘটনাবশত "স্ট্রেইট" হয়ে গেছি। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। আমি থেরাপি নিচ্ছিলাম। তবে স্ট্রেইট হতে চাই এমন কোন পরিকল্পনা থেকে সেটা নেওয়া হয়নি। আমার মাঝে কমিটমেন্ট রাখা নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল, সেটা বদলাবার আশাতেই থেরাপির শরণাপন্ন হওয়া। যৌনতা পরিবর্তনের ইচ্ছা আমার কোনোকালেই হয়নি। অথচ শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে! আমার সব কিছুই বদলে গেছে।
.
বিশ্বাসই হয় না, কয়েকশ'রও বেশি সমকামী পার্টনারের সাথে থাকার পর আমি কিনা বিয়ে করেছি একজন নারীকে! এমনকি আমাদের একটা সন্তানও আছে। সত্যি বলতে, আমার জীবনটাই পুরোপুরি বদলে গেছে। আগে খুব কোলাহল-প্রিয় ছিলাম। যেখানে যেতাম, সবার চেয়ে গলার স্বর উঁচু থাকত আমার। সবার সাথে গলাবাজি আর উদ্ধত আচরণ করতাম। নিজের ভেতরকার অনিশ্চয়তা লুকিয়ে রাখতে তটস্থ হয়ে থাকতাম, তাই হইচই করে বেড়াতাম, হট্টগোল আর দেমাক দেখিয়ে আমার নিরাপত্তাহীনতা চাপা দিতে চাইতাম। এখন আমার স্বভাব-চরিত্র একদম বদলে গেছে। তেজী, আশাবাদী একজন মানুষে পরিণত হয়েছি। যুদ্ধের মুভিগুলো দেখতে ভালো লাগে। ৪৬ বছর চলছে। এই ৪৬ বছরের মধ্যে নিজেকে নিয়ে এতটা খুশি আর কখনোই হই নি।
.
আমার কাহিনীর গভীরে যাওয়ার আগে শুরুটা বলি। শুরুটা হয়েছিল এভাবে - 
তখন আমার বয়স দশ কি এগার। আমার এক ছেলে কাজিন একদিন আমাকে বলল সে নাকি গে। আর তখনই আমার মনে হল, আমার আকর্ষণও আসলে একই রকম। দশ-এগারো বছর বয়স থেকে ছেলেরা মেয়েদের ব্যাপারে কৌতূহলী হতে থাকে, কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল ছেলেদের প্রতি।
.
আমার টিন-এইজ জীবনটা যেন এক রকম নরকের মধ্যে কাটতে লাগল। মাঝেমধ্যেই আত্মহত্যার কথা ভাবতাম, কখনও কখনও নিজের শরীরের বিভিন্ন ক্ষতি করতাম। ওদিকে মদ খাওয়া, পর্নোগ্রাফির সমস্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। সমকামীদের তৈরি বাজে সব ভিডিও-ক্লিপ দেখতাম। আমার বয়স যখন সতেরো চলছে, একদিন চোখের পানিতে ভেসে বাবা-মায়ের সামনে হাজির হলাম। কিন্তু আমার বাবা-মা সত্যিই অসাধারণ! তারা বললো, তারা আগে থেকেই আমার গে হবার ব্যাপারটা জানত। তারা আমাকে আশ্বস্ত করল, আমি গে হলেও তারা আমাকে নিঃস্বার্থভাবেই ভালোবাসবে। আমার স্কুলের বন্ধুবান্ধবেরাও বলল, তারাও নাকি আমার বিষয়টা বেশ কিছুদিন থেকেই টের পেয়েছে। তারাও আমাকে সমর্থন করল। সব মিলিয়ে আমার "গে" হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময়টা মারাত্মক ভয়াবহ বা যন্ত্রণাদায়ক কিছু ছিল না।
.
আঠারো বছর বয়সে, আমি নর্থ ইংল্যান্ড থেকে লন্ডনে চলে আসি। ততদিনে আমি গে হওয়াকে নিজের পরিচয় হিসেবে পুরোপুরি গ্রহণ করে নিয়েছি। আমার ভার্সিটিতে যে বিভাগে আমি পড়তাম, সেখানে আমিই সর্বপ্রথম গে হিসেবে জনসম্মুখে নিজের এই পরিচয় দিয়েছি। এমনকি ভার্সিটিতে একটা গ্রুপও খুলে ফেললাম। এলজিবিটি গ্রুপ। ছাত্রছাত্রীদেরকে জোরেসোরে বোঝাতে শুরু করলাম - যারা বলে গে হওয়াটা মানুষের ইচ্ছাধীন কিংবা গে হওয়া ভুল, তারা একেবারেই সঠিক না।
.
যা বলছিলাম, আমার কখনোই বদলাবার দরকার হয়নি। আমি জন্মেছি গে হয়ে, এটাই সবসময় জেনে এসেছি। ব্যাস খতম। আমি বড়ো হয়েছি ক্রিশ্চিয়ান হিসেবে, লন্ডনের সমকামী ক্রিশ্চিয়ানদের আন্দোলনে নিয়মিত যোগ দিতাম, কিন্তু খেয়াল করলাম আমি আসল মজা পাই শহরের সমকামীদের ক্লাবগুলোয় যখন নাচ-গান-পার্টি আর নেশা করি, তখন। অতিরিক্ত কামুক আর বিশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করতে শুরু করলাম। আমার ধারণা, সে সময় আমার পার্টনারের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে।
.
শেষমেশ আমি বহুদিনের পুরোনো এক বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেটল করলাম। সে একজন এক্স-সৈনিক, ফকল্যান্ড দ্বীপের পশুচিকিৎসক। আমরা ভাবছিলাম, দেশের বাইরে কোথাও গিয়ে বিয়ে করবো - অন্ততপক্ষে সামাজিকভাবে স্বীকৃত একটা সম্পর্ক শুরু করব। কিন্তু ঠিক সে সময়েই আমি অন্য আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লাম। তার নাম ক্রাইস্ট। এই সম্পর্কটাই আমাকে আমার জীবনটা গভীরভাবে যাচাই করার সুযোগ দেয়।
.
আমি বুঝতে পারলাম, আমার কিছু সমস্যা আছে। কমিটমেন্ট নিয়ে সমস্যা। আমি কারো সাথেই অঙ্গীকারবদ্ধ হতে পারিনা। আরও আবিষ্কার করলাম, আমি কারো থেকে "না" শুনতে পারিনা। আমার মধ্যে প্রত্যাখ্যিত হওয়া নিয়ে অসম্ভব একটা ভয় কাজ করে। ছোটোবেলা থেকেই আমি সব সময় বাড়াবাড়ি রকমের বিচলিত থাকতাম। আমার আশেপাশের মানুষদের ব্যবহার করতাম। আমার ভেতর জন্মগতভাবে পুরুষদের প্রতি একটা ভয় ছিল -- তারা সমকামিতাকে ঘৃণা করে সেটাকে আমি ভয় পেতাম না; বরং ভয়টা ছিল অন্য জায়গায়। আমার ভয় হতো পুরুষদের দেখে। আমার আর একজন সাধারণ "heterosexual" পুরুষের মাঝে যে বিস্তর ফারাক, সেটাই ছিল আমার ভয়ের মূল কারণ।
.
আমি সবকিছু নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করলাম। বহুদিনের পুরোনো পার্টনারের সাথে সম্পর্কের ইতি টানলাম। এক বন্ধুর পরামর্শে থেরাপি নিতে শুরু করলাম যাতে আমার কমিটমেন্ট রাখার বিষয়টা সারিয়ে তোলা যায়। থেরাপিতে গিয়ে যেসব সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি, তার কোনটাই পাশবিক, নির্মম, বা বিধ্বস্ত হবার মতো কিছু ছিল না। কিছু কিছু "গে থেকে স্ট্রেইটে রূপান্তর" ডকুমেন্টারিতে যেসব ভয়ঙ্কর কাহিনি শোনা যায়, তার কোনটাই আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমার থেরাপিটা ছিল মূলত কয়েকটা চিন্তাগত ও আচরণগত থেরাপির সমন্বয়। আমাকে আমার মজ্জাগত বিশ্বাসগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা হল, আমার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা নিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়া হত। আমার একপেশে ভাবনাগুলোকে যেন উপড়ে ফেলা যায়, আমার বহু বছরের বদ অভ্যাস, আমার সমস্যাপূর্ণ আচার-আচরণগুলোকে যেন বদলানো যায়, সেটাই ছিল এ থেরাপির উদ্দেশ্য।
.
আমি কেন খালি পুরুষদের প্রতি আকর্ষিত হই, তা নিয়ে আমার বা আমার থেরাপিস্ট কারোরই তেমন মাথাব্যথা ছিল না। তবে সঙ্গত কারণেই আমার গে হওয়া নিয়ে কথা বলাটা আলোচনার একটা অংশ ছিল, কারণ তা নাহলে আমার জীবনের একটা বড় অংশকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। পুরো সময়টায় একটা মূল কাজ ছিল- ক্ষমা করে দেওয়া। যাদেরকে মাফ করে দেওয়া প্রয়োজন, তাদেরকে মাফ করে দেওয়া। আর আরেকটা ব্যাপার, আমি আমার খুব কাছের কিছু মানুষের সাথে যে দেয়াল তৈরি করেছিলাম, বিশেষ করে আমার বাবা-মা ও ভাইবোনের সাথে, সেটা বোঝা।
.
ধীরে ধীরে আমার কাছে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম, আসলে বালক অবস্থায় আমি অন্যান্য পুরুষদের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারতাম না। ছোটোবেলা থেকেই ভাবতাম যে আমি অন্য পুরুষদের থেকে প্রত্যাখ্যিত হচ্ছি। আর তাই নিজের অজান্তেই নিজের ভেতর একটা প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম যে কখনও ছেলেদেরকে পুরোপুরি বা গভীরভাবে বিশ্বাস করব না। কেউ যখন আমার কাছে আসত, আমি তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতাম আর নিজেকে বড় ভাবতাম। আমার বাবা আর বড় দুই ভাইয়ের সাথেও আমি এমন আচরণই করেছি। তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। কাজেই "পুরুষ" ব্যাপারটা আমার জন্য রহস্যময় হয়ে দাঁড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর টিন-এইজে সেই রহস্যময়তা নেশায় রূপ নিল, আমি পুরুষ লোকের প্রতি দৈহিকভাবে আকর্ষিত হতে শুরু করলাম। সেই সাথে পর্নের মাধ্যমে নিজের এই সমস্যাটা দিনকে দিন আরো উসকে দিতে লাগলাম।
.
আমি বুঝতে পারলাম আমি নিজেকে নিঃসঙ্কোচে নারীদের জগতে ঠেলে দিয়েছিলাম। আমার পৌরুষত্ব এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোনো প্রভাব খাটাতে পারেনি। অথচ আমি নারীদেরও ঘৃণা করতাম! তারা এত সহজে সাধারণ (স্ট্রেইট) ছেলেদের মন ভুলাতে পারত যে আমার অসহ্য লাগত। কেননা আমি গে হয়ে এই কাজটা কখনোই করতে পারতাম না। আমি আবিষ্কার করলাম যে আমার স্থান স্বাভাবিক ভাবেই নারীদের মধ্যে নয়। আবার নিজেকে আমি পুরুষদের মধ্য থেকেও বের করে এনেছি।
.
আমার অস্তিত্বের একদম কেন্দ্রীয় অনেক ব্যাপারকে চ্যালেঞ্জ করা হল - আমার চেহারা, আমার দেহ, আমার হাঁটার ভঙ্গিমা -- আমার থেরাপিস্ট আমাকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন: কোন কোন ব্যাপারে আমি বাকি সব পুরুষের মতো ছিলাম, আর কোন কোন ব্যাপারে ছিলাম না। তিনি আমার গলার স্বর, চালচলন নিয়েও কাজ করছিলেন। সত্যি বলতে, আমাকে ভিন্ন ভাবে চিন্তা করার আর ভিন্ন ভাবে আচরণ করার একটা সুযোগ দিচ্ছিলেন।
.
আমার ভয়, উদ্বেগ আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। একটা সময় এমন হল যখন নারী-পুরুষ সবার কাছেই নিজেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হতে লাগল। আমার পুরুষ পরিচয়কে এতদিন পুরোপুরি অস্বীকার করে এসেছি, সেটাই এখন পুরোপুরি গ্রহণ করে নিলাম। আমার দাঁড়ানোর ভঙ্গি বদলে গেল, সোজা হয়ে দাঁড়াতাম। আগের মতো মেয়েলি ভাবে আর হাঁটতাম না, বড় বড় পা ফেলে একজন পুরুষের মতো হাঁটতে শুরু করলাম। এমনকি আমার গলার স্বরও পাল্টে ভারি হয়ে গেল। এতো সুন্দর ভরাট স্বর যে সবাই নিয়মিতই আমাকে আমার গলার স্বর নিয়ে কিছু একটা মন্তব্য দিতে লাগল।
.
আমার মনে হল, হয়ত বা, হয়ত বা আমি কখনোই সত্যিকার অর্থে গে ছিলাম না। হয়ত আমার মাঝে সবসময়ই এমন একজন পুরুষ ছিল, যে সত্যিকারের পুরুষ, যে এমন একজন উন্নত পুরুষ -- যেমন পুরুষদেরকে আমি বরাবর শ্রদ্ধার চোখে দেখেছি। হয়ত আমার ভেতরের এই পুরুষটি সবসময় মুক্ত স্বাধীন হওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
.
নারীদের সাথে দৈহিক মেলামেশা অনেক বেশি আনন্দায়ক লাগতে লাগল, এমনকি একজন নারীর চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার মাঝেই যে কত আনন্দ আছে সেটা বুঝতে পারলাম। একজন পুরুষ হবার আনন্দ উপভোগ করতে লাগলাম। নারীদের সঙ্গ বেশি প্রিয় হয়ে গেল। এর মানে এই না যে, আমি যত নারীকে দেখেছি সবার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছি! আমি উত্তপ্ত তরুণ ছিলাম না। বরং এটা ছিল একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যার ফলস্বরূপ প্রেম এবং সম্পর্ক শুরু হয়েছে।
.
আজ আমি একজন নারীর স্বামী। আট বছর যাবৎ আমরা বিবাহিত আছি। আর আমাদের একটা পাঁচ-বছর বয়সী মেয়েও আছে। আর্ট আর থিয়েটার ভালোবাসি। তবে টিম স্পোর্টসগুলো প্রচণ্ড টানে। আমার খুব প্রিয় একটা মুভি হলো - সেভিং প্রাইভেট রায়ান, এই মুভিতে ভ্রাতৃত্ববোধ আর পুরুষদের অন্তর্বর্তী বন্ধুত্বকে দেখানো হয়েছে -- যেই অসাধারণ জিনিসটা আমি আগে কখনোই উপভোগ করিনি।
.
অনেকে জিজ্ঞেস করে, আমি কি এখন পুরোপুরি একজন heterosexual? হ্যাঁ, প্রায় পুরোটা সময়ের জন্য এটাই সত্যি। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই এমন কিছু সময় আসে যখন যৌনতা বেশ বায়বীয় পর্যায়ে থাকে। হঠাৎ হঠাআমার ক্ষেত্রেও সেটা সত্যি। তবে আমি আমার ফেলে আসা গে লাইফস্টাইল মোটেও মিস করি না। আমার থেরাপিরও প্রায় পাঁচ বছর পরে, পুরোনো বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করেছিলাম। গে জীবনযাপনের ক্ষতিকর দিকগুলো তখন খুব ভালোভাবেই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমার এক্স-বয়ফ্রেন্ডের গলার স্বর দেখলাম একেবারে মেয়েলি আর কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে, শুধু তাই নয়, সে ততদিনে এইচআইভি-ও বাধিয়ে ফেলেছে।
.
সেই মুহূর্তে একটা ব্যাপার খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলাম - আমার থেরাপি নেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং বিকৃতভাবে গড়ে ওঠা যৌন-আকর্ষণকে সারিয়ে তোলার জন্য পরবর্তীতে নেওয়া আরেকটি থেরাপি শেষপর্যন্ত আমাকে রক্ষা করেছে! 
তবে আমার জীবনের পরিবর্তনগুলোর কারণে আমি কাউকে জোর করে বদলে যেতে বা "ধর্মপরিবর্তন" করে গে থেকে স্ট্রেইটে পরিণত হতে বলব না। কারো নিজেকে "কনভার্ট" হবার জন্য বাধ্য মনে করার দরকার নেই।
.
তবে একটি কথা বলব, আমি বিশ্বাস করি, মানুষ জন্মগত ভাবে গে হয় না। এবং যে কেউ-ই চাইলে নিজের ভেতর বাস করা লুকোনো সত্তাটি বের করে আনতে পারে। সেই সত্তা যেখানে আমি আমার পৌরুষত্বকে খুঁজে পেয়েছি।"
---
জেমস পার্কার।
[মূল লেখক জেমস পার্কার একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে কাজ করেন, যার নাম: জার্নি টু ম্যানহুড। প্রোগ্রামটি "পিপল ক্যান চেইঞ্জ" নামের একটি শিক্ষা ও সহযোগিতামূলক সংস্থা দ্বারা পরিচালিত।] 
----
কৃতজ্ঞতাঃ অনিকা তুবা। 
মূল পোস্ট লিংক- https://goo.gl/Ygfck9 


Monday, July 3, 2017

সমকামি এজেন্ডাঃ ব্লু-প্রিন্ট



১৯৮৭ সালে অ্যামেরিকান ম্যাগাযিন ‘গাইড’ এর নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় মার্শাল কার্ক এবং হান্টার ম্যাডসেনের লেখা প্রায় ৫০০০ শব্দের একটি আর্টিকেল। দু’বছর পর নিউরোসাইক্রিয়াট্রি রিসার্চার কার্ক এবং পাবলিক রিলেইশান্স কনসালটেন্ট ম্যাডসেন একে পরিণত করেন ৩৯৮ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে। হান্টার ও ম্যাডসেনের এই আর্টিকেল উপস্থাপিত ধারণা ও নীতিগুলো পরবর্তী ৩ দশক জুড়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে রাজনীতি, মিডিয়া, অ্যাকাডেমিয়া, বিজ্ঞান, দর্শন ও চিন্তার জগতে। সারা বিশ্বজুড়ে। সমকামীদের ম্যাগাযিন গাইডে প্রকাশিত মূল আর্টিকেলটির নাম ছিল “The Overhauling of Straight America ”। ৮৯ তে প্রকাশিত সম্প্রসারিত বইয়ের নাম দেওয়া হয় - After the Ball: How America Will Conquer Its Fear and Hatred of Gays in the 90s. কার্ক ও ম্যাডসেনের উদ্দেশ্য ছিল সিম্পল –সমকামিতা ও সমকামিদের প্রতি অ্যামেরিকানদের মনোভাব বদলে দেওয়ার জন্য একটি স্টেপ বাই স্টেপ ব্লু-প্রিন্ট বা ম্যানুয়াল তৈরি করা।
.
কিন্তু কেন প্রায় তিন দশক পর বাংলাদেশে বসে কার্ক-ম্যাডসেনকে নিয়ে চিন্তা করা? কার্ক-ম্যাডসেনের নাম শুনেছেন বা তাদের লেখার সম্পর্কে জানেন এবং মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। শুধু বাংলাদেশেই না, বিশ্বজুড়েই। কিন্তু তাদের ব্লু-প্রিন্টের প্রভাব কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করে নি এমন সমাজ বা রাষ্ট্র খুজে পাওয়াটাও কঠিন। গত ৩০ বছরে সমকামিতার স্বাভাবিকীকরন, সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমকামিতার মধ্য এতোটা অস্বাভাবিক একটি বিষয়ের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রায় হুবহু মিলে যায় কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের সাথে। আর বাংলাদেশেও সমকামিতার প্রচার, প্রসার এবং সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা তৈরির জন্য এখন এই একই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে, একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে ২২টি দেশে সমলৈঙ্গিক ‘বিয়ে’ আইনগত ভাবে স্বীকৃত। কোন আগ্রাসী সেনাবাহিনী শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এদেশগুলোর জনগোষ্ঠীর উপর সমকামিতা চাপিয়ে দেয় নি। তবে নিঃসন্দেহে মানুষের স্বভাবজাত মূল্যবোধ, ফিতরাহর বিরুদ্ধে গিয়ে জঘন্য একটি বিকৃতিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেওয়া, মানুষের মাঝে এই বিকৃতির গ্রহনযোগ্য তৈরি করা একটি যুদ্ধের অংশ। এই যুদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক, আদর্শিক। এই যুদ্ধ সর্বব্যাপী এবং ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আপনি এই যুদ্ধের অংশ। আর এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের স্ট্র্যাটিজির মূল ভিত্তি কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট। আর তাই কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট সম্পর্কে জানা, শত্রুর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা একটি আবশক্যতা, কোন অ্যাকাডেমিক কৌতুহল না। তবে কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের দিকে তাকানোর আগে গত তিন দশকে এর অর্জিত সাফল্যের দিকে একটু তাকানো যাক।

The Overhauling of Straight America

একটা সহজ উদাহরন দিয়ে শুরু করা যাক। Gallup এর হিসেব অনুযায়ী ৮৭-তে, অর্থাৎ আর্টিকেলটি লেখার সময়, যাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ৩২% সমকামি সম্পর্ক বৈধ হওয়া উচিৎ বলে উত্তর দিয়েছিল। ৫৭% বলেছিল এধরনের কাজ সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ঘোষণা করা উচিৎ। ত্রিশ বছর পর ২০১৫৭ তে এসে দেখা গেল ব্যাপারটা প্রায় পুরোপুরি উল্টে গেছে। ৬৪% উত্তরদাতা এখন মনে করেন এধরনের বিয়ে বৈধ হওয়া উচিৎ, আর মাত্র ৩৪% এর বিরুদ্ধে [১]। ১৯৮৯ সালে ১৯% উত্তরদাতা বিশ্বাস করতেন মানুষ জন্মসূত্রে সমকামি হয়। ৪৮% মনে করতেন সমকামিরা সমকামিতাকে স্বেচ্ছায় বেছে নেয়। ত্রিশ বছরের কম সময়ের মধ্যে তে ৪২% উত্তরদাতা বিশ্বাস করা শুরু করলো সমকামিতা জন্মগত [২]। অথচ ১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত খোদ অ্যামেরিকান সাইক্রিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশান সমকামিতাকে একটি মানসিক অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করতো। অর্থাৎ ৫০ বছর আগে যা বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল আজ অর্ধেকের বেশি মানুষ তার উল্টোটা বিশ্বাস করছে, যদিও সব বৈজ্ঞানিক গবেষনার ফলাফল বারবার বলছে সমকামিতার কোন জেনেটিক ভিত্তি নেই, এটি জন্মগত না, বরং স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া একটি বিকৃতি।
.
পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৫ তে এসে অ্যামেরিকান খ্রিস্টানদের ৫৪% মনে করে সমকামিতার বিরোধিতা করার বদলে সমকামিতাকে সামাজিক ভাবে মেনে নেওয়া উচিৎ। অ্যামেরিকান প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ৬২% সমকামি ‘বিয়ে’-কে সমর্থন করে, আর ৬৩% মনে করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর সমকামিতার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই [৩]। অথচ সমকামিতা যে একটি জঘন্য বিকৃতি, চরম পর্যায়ের সীমালঙ্ঘন এবং অত্যন্ত ঘৃণিত পাপাচার এ ব্যাপারে বাইবেলের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট।
.
অ্যামেরিকান সমকামিতা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ GLAAD এর সমীক্ষ অনুযায়ী ২০১৬ সালে রিলিয হওয়া প্রায় ১৭.৫% হলিউড সিনেমাতে LGBT (Lesbian,Gay, Bi-sexual, Queer) চরিত্রের উপস্থিতি ছিল [৪] । পাশাপাশি গত ১০ বছরের প্রায় সব প্রাইমটাইম টেলিভিশন শো-তে কমপক্ষে একটি সমকামি বা অন্যকোন বিকৃতকামি চরিত্র রাখা হয়েছে। কিন্তু Gallup এর মতে অ্যামেরিকার মোট সংখ্যার মাত্র ৩.৯% সমকামি। মিডিয়াতে সমকামিদের ওভাররিপ্রেসেন্টেশানের সঠিক মাত্রাটা বোঝার জন্য এ তথ্য মাথায় রাখুন যে অ্যামেরিকান মিডিয়ার দর্শক শুধু অ্যামেরিকাতেই সীমাবদ্ধ না। সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ অ্যামেরিকান মিডিয়ার দর্শক ও ভোক্তা। এই কোটি কোটি মানুষের কাছে অ্যামেরিকান মিডিয়া সমকামিতা, সমকামি ‘বিয়ে’, সমকামি যৌনাচারকে সাধারন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে।
.
সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী ২২টি দেশে সমকামি ‘বিয়ে’-কে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জার্মানির সংসদে গত ৩০শে জুন, ২০১৭ সমলৈঙ্গিক ‘বিয়ে’র স্বীকৃতিদানের পক্ষে বিল পাশ হয়েছে। উল্লেখ্য জার্মানির সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৪ জন নিজেদের মুসলিম হিসেবে দাবি করে থাকে। এই ৪জনই এই বিকৃতি ও চরম সীমালঙ্ঘনের আইনগত বৈধতা দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
.
রাজনীতি, অ্যাকাডেমিয়া এবং মিডিয়ার উপর এই ক্ষুদ্র বিকৃত মানসিকতার মাইনরটির প্রভাবের মাত্রা কতোটুকু তা শুধু উপরের তথ্যগুলোর আলোকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না। তবে একটা বেইসিক আইডিয়া এখান থেকে আপনি পাবেন। এই প্রভাবের উৎস কী? আর এই প্রভাবের ব্যাপ্তি কতোটুকু?
.
আর একটা তথ্য দেই। আপনি নিজেই বাকি হিসেবটা মিলিয়ে নিন।
.
পৃথিবী জুড়ে অনেকগুলো অ্যাডভোকেসি গ্রুপ সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও ধনী গ্রুপ হল HRC বা Human Rights Campaign। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে HRC-র বার্ষিক আয় ছিল ৩.৮৫ কোটি ডলার। এই অর্থের উৎস? বড় বড় কর্পোরেশানগুলোর কাছ থেকে পাওয়া ডোনেইশান। HRC এর ডোনার এবং কর্পোরেট পার্টনারদের মধ্যে আছে স্টারবাকস, লিবার্টি মিউচুয়াল ইনশুরেন্স, অ্যামেরিকান এয়ারলাইন্স, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, ব্যাঙ্ক অফ অ্যামেরিকা, শেভরন, কোকাকোলা, পেপসিকো, লেক্সাস অটো, গুগল, অ্যামাযন, আইবিএম, নাইকি, গোল্ডম্যান অ্যান্ড স্যাক্স, জেপি মরগান চেইস অ্যান্ড কো, ডেল, শেল অয়েলসহ আরো অনেকে [৫]।
.
বিশাল বাজেটের ব্যাপক প্রভাবশালী এসব অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আসলে কী করে? লবিয়িং এর মাধ্যমে, প্রেশার গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে এবং অবশ্যই অর্থের মাধ্যমে এরা প্রভাবিত করে মিডিয়াকে, রাজনীতিবিদদের, সমকামিতার সাথে সংশ্লিস্ট বিভিন্ন রিসার্চকে (যাতে করে সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করা যায়), এবং সরকারের পলিসিকে। যেমন অ্যামেরিকাতে এই মূহুর্তে অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো একটি প্রধান লক্ষ্য হল প্রতিটি স্কুলে, হাইস্কুল ও প্রাইমারি পর্যায়ে Gay-Straight Alliance Club অর্থাৎ স্বাভাবিক শিশু ও সমকামি শিশু ঐক্য পরিষদ জাতীয় কিছু তৈরি করা। প্রতিটি স্কুলে গড়ে ওঠা এই ক্লাবগুলোর কাজ হবে শিশুদের মধ্যে সমকামিতার প্রসার ঘটানো এবং স্বাভাবিকীকরন।

গ্লোবাল এজেন্ডা ও বাংলাদেশঃ

বিষয়গুলো শুধু অ্যামেরিকাতে বা পশ্চিমা বিশ্বে সীমাবদ্ধ না। বরং সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের এই এজেন্ডা গ্লোবাল, এবং বিশ্ব রাজনীতির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষণা করে সমকামিতা কোন অসুস্থতা না কোন বিকৃতিও না। অর্থাৎ সমকামিতা স্বাভাবিক। OHCHR, UNDP, UNFPA, UNHCR, UNICEF, UNODC, UN Women, WFP, ILO, UNESCO, World Bank এবং UNAIDS –সহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বৈষম্য নিরসন মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নামে উন্নতশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের জন্য কাজ করছে। এদের মধ্যে Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights (OHCHR) সমকামিতাকে মানবাধিকারের সংজ্ঞার ভেতরে ফেলে এর প্রচার করছে [৬] । OHCHR সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য Free & Equal নামে একটি আলাদা ক্যাম্পেইন চালু করেছে যার ঘোষিত উদ্দেশ্যে মাঝে আছে শিশুদের সমকামিতা সম্পর্কে সচেতন করা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ব্যবহারের মাধ্যমে সমকামিতা ও সমকামের প্রতি সহনশীলতা তৈরি করা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সমকামিতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা [৭] । Free & Equal ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে জাতিসঙ্ঘ সমকামি ‘বিয়ে’-কে বৈধতা দেয়ার জন্য বলিউডের মিউযিক ভিডিও-ও তৈরি করেছে।
.
পৃথিবীর যেকোন জায়গায় সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য যা কিছু করা হচ্ছে, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো এই গ্লোবাল এজেন্ডার অংশ। বাংলাদেশে যারা সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের জন্য এখনো পর্যন্ত যেসব কাজ করা হয়েছে তার সবকিছুই কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের সাথে খাপেখাপে মিলে যায়। একারনে তাদের কর্মপদ্ধতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বোঝার জন্য কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট সম্পর্কে ধারণা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা আলাদা ভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। বরং যে মডেলের মাধ্যমে অ্যামেরিকায় অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে এখন সেই একই মডেল বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই পায়ুকাম প্রচার করা ইয়াহু চ্যাট গ্রুপ, ফেইসবুক গ্রুপ, ফোরাম, রুপবান ম্যাগাযিন, শাহবাগে সমকামি প্যারেড, বইমেলায় সমকামিতা নিয়ে কবিতার বই প্রকাশ, গ্রামীনফোনের ফান্ডিং এ আরটিভিতে প্রচারিত নাটক, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও এনজিও গুলোর মাধ্যমে পায়ুকামে উৎসাহিত করা, বিনামূল্যে কনডম-লুব্রিকেন্ট বিতরণ - এই সবকিছুকে দেখতে হবে একটি বৃহৎ, গ্লোবাল এজেন্ডার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে। যে বিষয়টা উপলব্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল শত্রুপক্ষ জানে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ বা কম্পোনেন্টের যেকোন একটা দিয়ে রাতারাতি জনমত বদলে ফেলা যাবে না। সেটা তাদের উদ্দেশ্যও না। বরং তাদের উদ্দেশ্য হল ছোট ছোট ইঙ্ক্রিমেন্টাল পরিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সামাজিক মূল্যবোধকে বদলে দেওয়া। এটাই কালচারাল সাবভারশানের টাইম-টেস্টেড পদ্ধতি। হঠাৎ করে একটা বড় পরিবর্তন সমাজে উপর চাপিয়ে দিতে চাইলে সেটা ব্যাকফায়ার করার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যখন ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় পরিবর্তনটা উপস্থাপন করা হয় তখন এক পর্যায়ে গিয়ে সমাজ তা মেনে নেয়।
.
সহজ উদাহরনঃ একটা সময় বাংলাদেশে বুকে ওড়না না দিয়ে গলায় ওড়না দেয়াটা খারাপ মনে করা হতো। এই সময়টাতে যেসব মেয়েরা জিন্স-টিশার্ট পড়ে ঘুরে বেড়াতো তাদের ব্যাপারে সমাজের অধিকাংশের ধারণা ছিল এরা উগ্র, অশ্লীল ইত্যাদি। কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে যারা একসময় জিন্স-টিশার্ট পরিহিতাদের উগ্র বলতেন তারাই তাদের মেয়েদের এখন জিন্স-টিশার্ট পড়াচ্ছে, এবং ব্যাপারটা এখন প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ‘নরমাল’। গলায় ওড়না ঝোলানো থেকে টি-শার্টে আসার ব্যাপারটা রাতারাতি করার চেস্টা সমাজ মেনে নেয়নি। বিরোধিতা করেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন পরিবর্তন হয়েছে তখন সেই একই সমাজ খুশি মনে একে মেনে নিয়েছে।
.
কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের প্রথম ধাপ এটাই। মানুষকে সমকামিতার ব্যাপারে ডিসেনসেটাইয করা।
 
‘প্রথম কাজ হল সমকামি এবং সমকামিদের অধিকারের ব্যাপারে অ্যামেরিকার জনগনের চিন্তাকে 
অবশ করে দেওয়া,তাদের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে দেওয়া [desensitization]। মানুষের চিন্তাকে 
অবশ করে দেওয়ার অর্থ হল সমকামিতার ব্যাপারে তাদের মধ্যে উদাসীনতা তৈরি করা...একজন 
স্ট্রবেরি ফ্লেইভারের আইস্ক্রিম পছন্দ করে আরেকজন ভ্যানিলা।একজন বেইসবল দেখে আরেকজন 
ফুটবল। এ আর এমন কী!’ 
 [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]
 
কার্ক-ম্যাডসেনের মতে প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্দেশ্য এই একটি। সমকামিতা যে একটি জঘন্য বিকৃতি, চরম সীমালঙ্ঘন, ও ঘৃণ্য পাপাচার তা সম্পর্কে মানুষের সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করে দেওয়া। তাদের ভাষায় –
‘সমকামিতা একটি ভালো জিনিস - একেবারেই শুরুতেই তুমি সাধারন মানুষকে এটা বিশ্বাস করাতে 
পারবে, এমন আশা বাদ দাও। তবে যদি তুমি যদি তাদের চিন্তা করাতে পারো যে সমকামিতা হল 
আরেকটা জিনিষ (ভালো না খারাপ না –জাস্ট আরেকটা ব্যাপার) তাহলে ধরে নাও আইনগত ও 
সামাজিক অধিকারের আদায়ের লড়াইয়ে তুমি জিতে গেছো।’
 [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]
.
 সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য যারা কাজ করছে তাদের রেটোরিক খেয়াল করলে দেখবেন তাদের অধিকাংশ ঠিক এই মেসেজটাই দিতে চাচ্ছে। ‘সমকামিতা ভালো বা খারাপ না, জীবনের একটা বাস্তবতা মাত্র’। পহেলা বৈশাখের সময় শাহবাগে সমকামি প্যারেড কিংবা ঈদের সময় ঈদের নাটক হিসেবে সমকামিদের গল্প তুলে ধরার পেছনে একটি মূল উদ্দেশ্য হল সমাজের বিকৃতকামী এক্সট্রিম মাইনরিটিকে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা। একই সাথে সমকামিতাকে ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত করা, যেমনটা জাতিসংঘের Free & Equal ক্যাম্পেইনেও করা 
.
ভিকটিমহুড – সমকামিতা জন্মগতঃ কার্ক-ম্যাডসেনের আরেকটি সাজেশান হল সমকামিদের ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা। সমকামিদের ভিকটিম হিসেবে চিত্রিত করার দুটি ডাইমেনশান থাকবে। প্রথমত, সমকামিতাকে একটি সিদ্ধান্তের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বা জন্মগত হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে সমকামিদের জন্মগতভাবেই ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, সমকামিদের সমাজ দ্বারা নির্যাতিত হিসেবে চিহ্নিত করা।
.
বাংলাদেশে এবং বিশ্বজুড়ে যারা সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের কাজ করে তাদের প্রপাগ্যান্ডা ও বক্তব্য আপনি সবসময় এ দুটো মোটিফ দেখতে পাবেন।
.
সমকামিরা জন্মগতভাবেই সমকামি এটা প্রমানের উদ্দেশ্য হল যদি সমকামিতাকে জন্মগত বা প্রাকৃতিক প্রমান করা যায় তাহলে সমকামিদের সম্পূর্ণ নৈতিক দায়মুক্তি সম্ভব। সমকামিতা যদি জন্মগত হয় তাহলে সমকামিতা একটি ‘অ্যাক্ট’ বা ক্রিয়া হিসেবে নৈতিকভাবে নিউট্রাল, কারন এর উপর ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রন নেই। কিন্তু সমকামি জন্মগত – এই দাবির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তো নেই-ই, বরং বিভিন্ন পরীক্ষা ফলাফল ইঙ্গিত করে যে Sexual Oreintation নির্ভর করে ব্যক্তির ‘চয়েস’ বা স্বেচ্ছায় গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর [৮]।
.
আরেকটি বিষয় হল সমকামিতা যদি জন্মগত হয় তাহলে অন্যান্য বিকৃত যৌনাচার কেন জন্মগত বলে গন্য হবে না? শিশুকামি, বা পশুকামিদের কেন অপরাধী গণ্য করা হবে? ইন ফ্যাক্ট শিশুকামের সাথে সমকামের, বিশেষ করে পায়ুকামের সম্পর্ক তো হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন গ্রিসে শিশুদের সাথে মধ্য বয়স্ক পুরুষদের পায়ুকামী সম্পর্ক বা Pederasty প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে চালু ছিল প্লেইটো তার রিপাবলিক ও ল’স – রচনাতে প্রাচীন পেডেরাস্টি এবং সমকামিতার ব্যাপক প্রচলনকে গ্রীসের অধঃপতনের একটি কারন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। অ্যামেরিকাতেও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের সাথে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারের জন্য আন্দোলন করা NAMBLA (North American Man Boy Love Association) – দীর্ঘদিন ছিল গে-প্রাইড প্যারেডের নিয়মিত অংশ। বিখ্যাত অ্যামেরিকান কবি সমকামি অ্যালেন গিন্সবার্গ (সেপ্টেবর অন যশোর রোড – এর লেখক) ছিল NAMBLA এর সদস্য। এছাড়া অসংখ্য সমীক্ষার মাধ্যমে একথা প্রমাণিত যে সমকামিতার সাথে অন্যান্য যৌন বিকৃতির বিশেষ করে শিশুকামিতার ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে [ ৯]। সমকামিতার বিশেষ করে পায়ুকামিতার সাথে শিশুকামের গভীর সম্পর্কের ব্যাপারে সংক্ষেপে বোঝার জন্য পায়ুকামি ও শিশুকামি কেভিন বিশপের এই উক্তিটি যথেষ্ট -
 
"Scratch the average homosexual and you will find a pedophile" 
[Kevin Bishop in an interview. Angella Johnson, “The man who loves to love boys,” 
Electronic Mail & Guardian, June 30, 1997]
.
সুতরাং যদি সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষন জন্মগত হতে পারে তাহলে সমলিঙ্গের অল্পবয়েসীদের প্রতি আকর্ষন কেন জন্মগত হতে পারবে না? কেন ধর্ষনের তাড়না অনুভব ধর্ষকরা জন্মগত বিচ্যুতির কারনে ভিকটিম গণ্য হবে না? কেন পশুকাম জন্মগত বলে গণ্য হবে না? Sexual Oreintation যদি জন্মগতই তবে কেন তা কেবলমাত্র সমকামিদের ক্ষেত্রে জন্মগত বলে বিবেচিত হবে?
.
কিন্তু সব যুক্তি, প্রমান এবং বিবেচনাবোধের বিরুদ্ধে গিয়ে সমকামের প্রচারকরা একে জন্মগত বলে যাচ্ছে। আর ‘জন্মগত’ এই বৈশিষ্ট্যের কারনে কেন সমকামিদের আলাদা ভাবে দেখা হবে, এ নিয়ে আবেগঘন বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে। এবং এ দুটি দিক থেকে সমকামিদের ভিকটিম প্রমান করার মাধ্যমে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
 .
মিডিয়াঃ কার্ক-ম্যাডসেনের মতে সমকামিতার স্বাভাবিকীকরন ও গ্রহনযোগ্যতা তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের একটি হল মিডিয়া। বিশেষ করে ভিযুয়াল মিডিয়া –
‘সোজা ভাষায়, ভিযুয়াল মিডিয়া, টিভি ও সিনেমা হল ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে পশ্চিমা সভ্যতার 
সবচেয়ে শক্তিশালি মাধ্যম। অ্যামেরিকান প্রতিদিন গড়ে টিভি দেখে। এই সাতঘন্টা সময় সাধারন মানুষের 
চিন্তার জগতে ঢোকার এমন একটি দরজা আমাদের জন্য খুলে রেখেছে যার মধ্য দিয়ে একটা ট্রোজান 
হর্স ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব...যতো বেশি ও যতো উচ্চস্বরে সম্ভব,সমকাম, সমকামিতা এবং সমকামিদের 
কথা বলুন। বারবার দেখতে দেখতে থাকলে প্রায় যেকোন কাজই মানুষের কাছে ‘নরমাল’ মনে হওয়া 
শুরু করে...তবে মানুষের সামনে আগেই সমকামি আচরণ উপস্থাপন করা যাবে না – কারন তা মানুষের 
কাছে জঘন্য বলে মনে হবে এবং মানুষ সমকামিতার বিরুদ্ধে চলে যাবে। তাই সমকামিদের যৌনাচার 
সাধারন মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যাবে না। আগে তাবুর মধ্যে উটের নাক ঢুকাতে দিন, তারপর 
আস্তে আস্তে বাকিটাও ঢুকানো যাবে।’
 [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]

.আর বাস্তবিকই ধীরে ধীরে এই দরজার মধ্য দিয়ে ট্রোজান হর্স ঢুকাতে সমকামি মাফিয়া সমর্থ হয়েছে। ৯০ এবং ২০০০ এর প্রথম দশক জুড়ে বিভিন্ন ডেইলি সোপ ধীরে ধীরে সাধারন অ্যামেরিকানদের মধ্যে সমকামিতার গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জৌ বাইডেন ২০১২ সালে সরাসরি সমকামিতা প্রচার করা টিভি সিরিয ‘উইল অ্যান্ড গ্রেইস’-এর নাম উল্লেখ করে বলে –
 
“একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে একজন নারী আরেকজন নারীকে বিয়ে করবে এতে আমার 
বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই...আমার মনে হয় না অ্যামেরিকান মানুষকে (সমকামিতা সম্পর্কে) শিক্ষা 
দেয়ার ব্যাপারে উইল অ্যান্ড গ্রেইসের মতো ভূমিকা আর কেউ বা আর কোন কিছু রাখতে পেরেছে। 
যা অন্যরকম মানুষ সেটাকে ভয় পায়। কিন্তু এখন মানুষ (সমকামিতার ব্যাপারে) বুঝতে শুরু 
করেছে।”[১০]

আর একইভাবে আজ বাংলাদেশেও এই একই দরজার ভেতর দিয়ে সেই একই ট্রোজান হর্স ঢোকানোর জন্য কর্মতৎপরতা চলছে। কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট বাংলাদেশে প্রায় অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সমকামিতার প্রচারে মিডিয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্ক-ম্যাডসেনের মত ছিল প্রাথমিকভাবে প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করা, এবং তারপর ধীরে ধীরে ভিযুয়াল মিডিয়ার দিকে আগানো। বাংলাদেশে সমকামিতা প্রচারের কাজ শুরু হয় ৯০ এর দশকের শেষের দিকে।

প্রাথমিকভাবে সমকামিতা প্রচারকদের কাজ ছিল অনলাইন চ্যাট গ্রুপ, মেইল গ্রুপ, ফোরাম ইত্যাদির মাধ্যমে সমকামিদের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচিতি তৈরি করা, বিভিন্ন সময় একত্রে ‘মিলিত’ হওয়া এবং কিছু নির্দিষ্ট অঙ্গনে সমকামিতার প্রচার করা, এবং সমকামিতার পক্ষে জনমত তৈরি করা। পাবলিক স্ফেয়ারে যখন তারা তাদের বিকৃতি প্রচারের শুরু করে তখন তারা সেটা করে প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে। ২০১০ সালে বইমেলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে বের হয় কুখ্যাত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামেরিকা প্রবাসি ইসলামবিদ্বেষি অভিজিৎ রায়ের বই ‘সমকামিতা’। অভিজিৎ রায় এই বইয়ে বিজ্ঞানের জগাখিচুড়ি ব্যাখ্যা দিয়ে, এবং নানা লজিকাল ফ্যালাসি ব্যবহার করে সমকামিতা-কে স্বাভাবিক মানবিক আচরণ হিসেবে প্রমান করার চেষ্টা করে। তার অন্যান্য লেখার মতো এই লেখাটিও ছিল মূলত বিভিন্ন পশ্চিমা লেখকের লেখার ছায়া অনুবাদ। ২০১০ সালে অগাস্টে আলতাফ শাহনেওয়াজ নামে একজনের লেখা অভিজিৎ রায়ের বইটির রিভিউ প্রকাশ করে প্রথম আলো। আর এর মাধ্যমে প্রায় সবার অলক্ষ্যে তাদের বিশাল পাঠকবেইসের ড্রয়িং রূপে এই জঘন্য বিকৃতির সাফাই পৌছে দেয় প্রথম আলো। 
.
বাংলাদেশে প্রকাশ্যে সমকামিতার প্রসারে পরবর্তী বড় পদক্ষেপটি আসে ২০১৪ সালে, রূপবান নামে একটি ম্যাগাযিনের মাধ্যমে। আর এই ম্যাগাযিনের পক্ষে প্রচারনা চালানো হয় প্রিন্ট মিডিয়া (যেমন ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে) এবং অনলাইনের মাধ্যমে। ২০১৪ সালে রূপবানের প্রথম সংখ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ হাই-কমিশনার রবার্ট গিবসন, ব্যারিস্টার সারা হোসেনসহ আরো অনেকে। এ থেকে গ্লোবাল সমকামি মাফিয়ার প্রভাব এবং বাংলাদেশে এদের বিস্তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ম্যাগাযিনটির প্রকাশনার খবর ফলাও করে প্রচার করা হয় ডেইলি স্টার, বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ট্রিবিউন, বিবিসি সহ বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যমে। রূপবান পত্রিকার সম্পাদক ছিল সাবেক পররাস্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির আত্মীয় অ্যামেরিকান দূতাবাসে চাকরিরত জুলহাস মান্নান। পরবর্তীতে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা অভিজিৎ রায় এবং জুলহাস মান্নানকে যথাক্রমে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হত্যা করে [১১]।
.
কার্ক-ম্যাডসেনের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যবহারের পর এবার বাংলাদেশে সমকামিতার প্রচারকরা ভিযুয়াল মিডিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছে। সম্প্রতি আরটিভিতে প্রচারিত নাটক তাই নতুন কিছু না, বরং প্রায় দুই দশক পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নতুন একট পর্যায়ের শুরু কেবল। গ্রামীনফোন প্রযোজিত এই নাটকে হুবহু কার্ক-ম্যাডসেনের শিখিয়ে দেওয়া ‘যুক্তি’গুলোই তুলে ধরা হয়েছে, এবং নাটকের ডায়ালগের মাধ্যমে সমকামিতাকে জন্মগত ও স্বাভাবিক, এবং সমকামিতা নৈতিকভাবে নিউট্রাল একটি কাজ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। নাটকে দেখানো হয়েছে সমকামি চরিত্রের পক্ষ নিয়ে একটি চরিত্র আরেকটি চরিত্রকে বলছেঃ 

‘ও পায়ুকামি (not straight), এটা কি ওর দোষ? সে কি এটাকে বেছে নিয়েছে? না। ওয়ার্ল্ডে নানা 
ধরনের মানুষ থাকে, তাহলে ও কেন থাকতে পারবে না? ও কি অস্বাভাবিক? না। ও কি একজন 
অপরাধী? না। ও তোমার আমার মতোই নরমাল মানুষ।’ 
[রেইনবো,আরটিভি,নির্মাতাঃ আশফাক নিপুন, প্রযোজনাঃ গ্রামীন ফোন ] 

যদি বাংলাদেশে কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট নির্বিঘ্নে অনুসৃত হতে থাকে তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এরকম আরো অনেক নাটক, শর্টফিল্ম, স্কিট এবং জনসচেতনতা মূলক বিজ্ঞাপন দেখতে পাবো। এক পর্যায়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাগুলোতে সমকামিতার স্বপক্ষে প্রবন্ধ ছাপা হবে। সমকামিতা নিয়ে বানানো নাটক ও সিনেমাকে জাতীয় পুরষ্কার, মেরিল প্রথম-আলো পুরস্কার সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমকামি অধিকার সম্পর্কে প্রকাশ্যে নানা ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হবে, পাবলিক স্কুলের কারিকুলামে সমকামিতা ও সমকামি অধিকার সম্পর্কে আলোচনা যুক্ত করা হবে। এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে সমকামি কোন তরুন বা তরুণীকে দেশী ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে ইয়ুথ আইকন হিসেবে উপস্থাপন করা হবে। আর এভাবে ধীরে ধীরে সমকামিতাকে সামাজিক ও রাস্ট্রীয়ভাবে গ্রহনযোগ্য করে তোলা হবে একসময় একে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অথবা আইনগত স্বীকৃতি ছাড়াই একসময় সমকামিতে সমাজে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা লাভ করবে, যেমনটা বর্তমানে যিনার ক্ষেত্রে হয়েছে। 
.
যদি এইভাবেই চলতে থাকে তাহলে অত্যন্ত অন্ধকার এক ভবিষ্যৎ এর মোকাবেলা আমাদের করতে হবে। তাই এ ব্যাপারটা বোঝা জরুরী যে এ দ্বন্দ্বটা শামোয়ীক কিছু না। কোন একটা নাটক বা বই বা ম্যাগাযিনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ সমকামিতাকে রাতারাতি গ্রহনযোগ্যতা দিতে চাচ্ছে না। এই নাটক, বই বা ম্যাগাযিনগুলোও এভাবে বানানো হচ্ছে না। তারা চাচ্ছে ক্রমাগত মানুষের সামনে সমকামিতা, ও সমকামিতার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে, সমকামিতাকে স্বাভাবিক প্রমান করতে। প্রাকৃতিক প্রমান করতে। এই ব্যাপারে মানুষের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে দিতে। মানুষকে ডিসেনসেটাইয করতে। জনমতকে পরিবর্তন করতে, সামাজিক মূল্যবোধকে বদলে দিতে। প্রতিপক্ষের আছে প্রায় অফুরন্ত ফান্ডিং, মিডিয়া এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক প্রশাসনিক সমর্থন। সুতরাং একটি নাটকের পর সেই নাটক নিয়ে লেখালেখি করলে অনেক মানুষ এসব সম্পর্কে জেনে যাবে – এমন ধারণা যেমন সঠিক না, তেমনি ভাবে একটি নাটকের পর কেবলমাত্র আরটিভি-গ্রামীনফোন বর্জনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে হারানো যাবে এমন চিন্তা করাও ভুল। যদি আসলেই এই বিশাল মেশিনারীকে থামাতে হয়, যদি এই এজেন্ডার বাস্তবায়নকে বন্ধ করতে হয় তাহলে সমকামি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পেছনে থাকা কাঠামো সম্পর্কে জানতে হবে, একে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তবে সেই আলোচনা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।

=========================
লেখক- Asif Adnan 
=========================
আরো পড়ুনঃ
সমকামীদের মিথ্যা দাবী এবং নাস্তিকদের মিথ্যাচার (প্রথম পর্ব)- http://bit.ly/2fiqYCV
সমকামীদের মিথ্যা দাবী এবং নাস্তিকদের মিথ্যাচার (দ্বিতীয় পর্ব)- http://bit.ly/2f7f8bK
সমকামীদের মিথ্যা দাবী এবং নাস্তিকদের মিথ্যাচার (তৃতীয় পর্ব)- http://bit.ly/2eAKeKx
সমকামীদের মিথ্যা দাবী এবং নাস্তিকদের মিথ্যাচার (শেষ পর্ব) - https://goo.gl/TL4Lah
সমকামিতা,স্বাধীনতা,রোগ নাকি অন্য কিছু – https://goo.gl/ivVWhe
সমকামিতার শাস্তি - https://goo.gl/OCHKGq
=========================
[৯] ক) ১৯৭৯ এ পায়ুকামি গবেষক জে ও ইয়াং এর ‘The Gay Report’ অনুযায়ী ৭৩% পায়ুকামি উত্তরদাতা বলেছে তারা কোন না কোন সময়ে ১৬-১৯ বছরের কম বয়েসী ছেলেদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। [Jay and A. Young, The Gay Report (New York: Summit Books, 1979), p. 275)]
খ) শিশু যৌন নির্যাতনের উপর চালানো একটি কানেইডিয়ান সমীক্ষা দেখা যায় অপরিচিত শিশুদের (non-familial victims) উপর যৌন নির্যাতন চালানো ৯১% শিশু নির্যাতনকারী বলেছে তারা কখনো সম/পায়ুকামি সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন রকম যৌন সম্পর্কে জড়ায়নি [অর্থাৎ তারা সমকামি]। [ W. L. Marshall, et al., "Early onset and deviant sexuality in child molesters," Journal of interpersonal Violence 6 (1991): 323-336, cited in "Pedophilia: The Part of Homosexuality They Don't Want You to see," Colorado for Family Values Report, Vol. 14, March 1994. ]
গ) যদিও পায়ুকামিরা অ্যামেরিকার মোট জনগোষ্ঠীর ২% এরও কম কিন্তু শিশুদের উপর চালানো যৌন নির্যাতনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সংঘটিত হয় তাদের দ্বারাই। [The Proportions of Heterosexual and Homosexual Pedophiles Among Sex Offenders Against Children: An Exploratory Study," Journal of Sex and Marital Therapy 18 (Spring 1992): 3443, cited in "The Problem of Pedophilia," op. cit. Also, K. Freund and R.I. Watson, "Pedophilia and Heterosexuality vs. Homosexuality," Journal of Sex and Marital Therapy 10 (Fall 1984): 197, cited in NARTH Fact Sheet. )]
ঘ) সমকামি ম্যাগাযিন ‘Advocate’ – এর ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন সেকশানের উপর চালানো একটি কন্টেন্ট স্টাডিতে ডঃ জুডিথ রেইসমান এবং ডঃ চার্লস জনসন দেখতে পান, পায়ুকামি যৌসম্পর্কের জন্য সঙ্গীর খোজে দেওয়া এসব বিজ্ঞাপনের বিশাল একটি অংশ হল ‘চিকেন’-দের [পায়ুকামিদের নিজেদের মধ্যে প্রচলিত স্ল্যাং] বা অপ্রাপ্তবয়স্ক খোজে। [Judith A. Reisman, Ph.D., "A Content Analysis of 'The Advocate,"' unpublished manuscript p. 18, quoted in "Pedophilia: The Part of Homosexuality They Don't WantYou to See," ibid. )]

Sunday, July 2, 2017

‘মিথ্যায় বসত’ (প্রথম পর্ব)


বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম ।
এক.
সক্কাল সক্কাল দুর্গা নাম জপতে জপতে  নাদুস নুদুস রসগোল্লা খাওয়া চেহারার  পুরুত মশাই লালমাটির পথ ধরে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছিলেনতার হাতে একটা দড়ি । দড়ির শেষ মাথায়  পুরুত মশাইয়ের মতোই একটা নাদুস নুদুস পাঁঠা বাঁধা । পাঁঠাটা মনিবের মতোই হেলেদুলে মনিবের পেছনে পেছনে হেঁটে যাচ্ছে । পুরুত মশাইয়ের গন্তব্য গো-ছাগলের হাট  
.
পুরুত মশাই পাঁঠা নিয়ে যে পথ ধরে যাচ্ছিলেন সেই পথেরই ধারে এক বটগাছের নীচে বসে ছিল ত্রিরত্ন; নীতাই,মধু আর গঙ্গা । নীতাই আর মধু তাস পিটাচ্ছিল । গঙ্গা বসে বসে  তাই দেখছিল আর বিড়ি ফুঁকছিল  । পুরুত মশাই তার পাঁঠা নিয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন । একই পাড়ায় বাড়ি তাদের সবারই । পুরুত মশাইকে দেখে নীতাই আর মধু তাস পেটানো বন্ধ করে তার দিকে চাইলো, গঙ্গা বিড়ি লুকিয়ে ফেলে একটা নমস্কার করলো, কিন্তু পুরুত মশাই খেয়ালই করলেন না ! কি ভাবতে ভাবতে নিজের পথে চলে গেলেন  । গঙ্গা তার গমনপথের দিকে  তাকিয়ে  কষে একটা গালি দিল । পাঁঠাটা দেখা মাত্রই নীতাই এর মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এসেছিল । কিন্ত পুরুত মশাইয়ের পাঁঠা ভেবে সঙ্গে সঙ্গেই মাথা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল দুষ্টু বুদ্ধিটা । পুরুত মশাইএর এমন ব্যবহারের পর  দুষ্টুবুদ্ধিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো ।গঙ্গা আর মধুকে সবকিছু বলে দ্রুত সলা-পরামর্শ করে নিল । বিচিত্র  একটা হাসি ফুটে উঠলো তিনজনের মুখেই
.
একছুটে কিছুটা ভিনপথ ঘুরে মধু হাজির হলো পুরুত মশাইয়ের সামনে ।
“নমস্কার! পুরুত মশাই কোথায় চললেন এই নেড়ি কুত্তাটা নিয়ে” ।
“ছোকরা! চোখের কি মাথা খেয়েচিস  ! এটা নেড়ি কুত্তা হবে কেন ? এটা তো পাঁঠা । হাটে নিয়ে যাচ্চি বেচব বলে”। 
.
রাগে গজরাতে গজরাতে হেঁটে চললেন পুরুত মশাই । কলিযুগে আর কতকি দেখব ! সেদিনের পুঁচকে ছোড়া আমার সঙ্গে করে ফাজলামি!  একটু পরে সামনে পড়লো গঙ্গা
“নমস্কার! তা পুরুত মশাই কুত্তার গলায় দড়ি বেঁধে কোতায় নিয়ে যাচ্চেন”? 
পুরত মশাই এবার আগের মতো রাগলেন না ।  কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললেন,“তোমাদের আজ কি হলো বলো তো ,বাপু? একটু আগে মধুও এই পাঁঠাকে  বলল  কুত্তা । এখন তুমিও বলচো”। 
গঙ্গা মাথার দিব্যি দিয়ে বললো  যে এটা পাঁঠা নয় ,একটা লোম ওঠা নেড়ি কুত্তা ।
পুরুত মশাই বিড়বিড় করতে করতে হাঁটা শুরু করলেন । সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলেন পাঁঠার দিকে ।  ভয় পেতে শুরু করলেন তিনি । শেষ বয়সে মাথাটা কি গেল? পাগল হয়ে গেলাম? ঠাকুরদার অবশ্যি শেষ বয়সে মাথাটা বিগড়ে গিয়েছিল ।
.
কিছুক্ষন পরেই তার সঙ্গে দেখা হল  নিতাইয়ের । নিতাই সঙ্গে সঙ্গেই পুরুত মশাইকে জিজ্ঞাসা করল তিনি কেন কুত্তার গলায় দড়ি পড়িয়েছেন আর তাকে কোথায়ই বা নিয়ে যাচ্ছেন । পুরুত মশাই যখন দুর্বল স্বরে বললেন এটা কুত্তা নয়, পাঁঠা তখন  নিতাই মা কালীর দিব্যি খেয়ে বললো এটা কুত্তা ।
পুরুত মশাই  শতভাগ  নিশ্চিত হলেন যে এই শেষবয়সে এসে তার মাথাটা সত্যিই বিগড়ে গেছে। পাঁঠাটার গলার দড়ি খুলে দিয়ে,‘হেই কুত্তা যা যা, ছেই ছেই’ বলে তিনি তাড়িয়ে দিলেন। তারপর  উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোলা চোখে হাঁটা ধরলেন বাড়ির পথে । 
.
মধু,গঙ্গা,নিতাই কাছে পিঠেই ছিল। পুরুত মশাই চোখের আড়াল হতেই তারা দৌড়ে যেয়ে পাঁঠাটা ধরে ফেললো। তারপর কেলো হাসি দিয়ে রওয়ানা দিল  চক্রবর্তীদের আমবাগানের দিকে। পাঁঠার মাংস দিয়ে সেই একটা ভোজ হবে আজ !
.


গল্পটা পড়েছিলাম অনেক দিন আগে ইংরেজিতে, ইংরেজি পড়া শিখেছি কেবল তখন। গল্পের ত্রিরত্ন; গঙ্গা,নিতাই আর মধু মিলে  ছকে ফেলে যেভাবে পুরুতমশায়ের পাঁঠা’টা সাবাড় করে ফেললো তা খুব ক্ল্যাসিকাল একটা টেকনিক। পৃথিবীর ইতিহাসে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে এই টেকনিকটা, মক্কার কুরাইশ থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের ক্রুসেডার আমেরিকা,ফ্রান্স,ইংল্যান্ড,জার্মানি- বাদ যায়নি কেউইইংরেজিতে গালভরা একটা নাম দেওয়া হয়েছে এর-‘ The Big Lie Theory
.
সোজা বাংলায়‘Big Lie Theory’ হলঃ  একটা মিথ্যে কথা তা যতোই বড় হোকনা কেন,তা যদি বারবার, বারবার বলা হতে থাকে তাহলে ম্যাঙ্গো পিপল একসময় সেটা  সত্যি বলে ধরে নেয়।
পুরুত মশাই যেমন একটা মিথ্যে কথা পরপর তিনজনের মুখ থেকে শুনে তা সত্যি বলে ধরে নিলেন। 
.
Big Lie Theory’ এর সাথে নাৎসিদের নাম জড়িয়ে থাকলেও, সবচেয়ে চৌকস ভাবে এর ব্যবহার করেছে নব্য ক্রুসেডার আমেরিকা,ফ্রান্স,ইংল্যান্ড,জার্মানি,রাশিয়া,ইন্ডিয়া এন্ড কোং ।
.
টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক প্রেস কনফারেন্সেDepartment of Homeland Security (DHS) secretary John Kellyট্রাম্পপ্রশাসনের সাতটি মুসলিমদেশের নাগরিকদের আমেরিকাতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ‘আমরা আমেরিকারনাগরিকদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে পারিনা
.
অর্থাৎ আমেরিকার প্রশাসন বলতে চাইছে এই মুসলিমদেশের নাগরিকদের হাতে আমেরিকানদেরজীবন একেবারেই  নিরাপদ নয় তারাআমেরিকার মাটিতে পা দিতে পারলেইআমেরিকানদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলবে
.
২০১৬ সালের এক জরিপ চালানোর সময় ১৫০০ আমেরিকানকে প্রশ্ন করা হয় তারা সবচেয়ে কিসের ভয়ে ভীত।
 প্রথম পাঁচটা বিষয়ের ২ এবং ৪ নম্বরে ছিল টেররিজম বা সন্ত্রাসবাদ।
.
সন্ত্রাসবাদ আমেরিকানদের জন্য আসলেই কি এতো বড়হুমকি এবং ক্ষতির কারন?
.
New America Foundation এর মতে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৯৪ জন আমেরিকার মাটিতে জিহাদীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন, ঠিক একই সময়ে আমেরিকার মাটিতে ৩ লক্ষ ১ হাজার ৭৯৭ জন প্রাণ হারিয়েছে বন্দুকের গুলিতে ! 
একজন আমেরিকানের ক্যান্সার অথবা হার্টের অসুখে মৃত্যুবরণ করার সম্ভাবনা  রিফিউজি সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যু বরণ করার চেয়ে ৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন গুন বেশি, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার সম্ভাবনা  রিফিউজি সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যু বরণ করার চেয়ে  ৪ লক্ষ ৭ হাজার গুন বেশি, বজ্রপাতে মারা যাবার সম্ভাবনা ২৬০ গুন বেশি। এমনকি শার্কের আক্রমণে (পৃথিবীতে শার্কের আক্রমণে মানুষ নিহত হবার ঘটনা খুবই বিরল ) একজন আমেরিকানের মারা যাবার সম্ভাবনা রিফিউজি সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যু বরণ করার চেয়ে ৬ গুন বেশি।
.
তাহলে কেন সন্ত্রাসবাদকে মারাত্মক হুমকি মনে করছে আমেরিকানরা? মুসলিমদের রক্তলোলুপ পিশাচ হিসেবে বিবেচনা করছে?

উত্তর-  Big Lie Theoryমিডিয়া,নাটক,সিনেমা, উপন্যাস,সংবাদমাধ্যম,পেইড দালাল  সম্ভাব্য সবরকম উপায়ে  ‘সন্ত্রাসবাদ আমেরিকানদের জন্য মারাত্মক হুমকি’ এই ভয়ংকর মিথ্যেটা জনগণকে বারবার বলা হয়েছে । আর সাধারণ জনগন সেটা বিশ্বাস করেই বসে আছে।
  
দুই.
এই পৃথিবীর ইতিহাস (মানব জাতির ইতিহাসও বলা যায়) হল হক ও বাতিলের দ্বন্দের ইতিহাস।জান্নাতে সেই আদম(আঃ) আর শয়তানের লড়াই থেকে শুরু। এরপর যুগে যুগে কালে কালে লড়াই হয়েছে ইব্রাহীম (আঃ) আর নমরুদের,মূসা (আঃ) আর ফেরআউনের, মুহাম্মাদর () আর আবু জেহেলদের। হক ও বাতিলের লড়াই এখনো চলছে,চলবে কিয়ামতের আগ পর্যন্ত। ইবলীশ’তো  অহংকারের বশে আল্লাহ্‌কে (সুবঃ) চ্যালেঞ্জ করেই রেখেছে...
.
‘সে( ইবলিশ) বললো, যেহেতু তুমি আমাকে এই আদমের জন্যেই আমাকে গোমরাহীতে নিমজ্জিত করলে,তাই আমিও এদের গোমরাহ করার জন্য তোমার প্রদর্শিত সরল পথের বাঁকে বাঁকে ওথ পেতে থকাবো। অতঃপর পথভ্রষ্ট করার জন্য আমি অবশ্যই তাদের কাছে আসবো ......’
[সূরা-৭;১৬-১৭] 
.
আদম সন্তানকে পথ ভ্রষ্ট করার জন্য শয়তানের খুব কার্যকরী একটা হাতিয়ার হলো মানুষের যৌনপ্রবৃত্তিমানুষের যৌন প্রবৃত্তিকে তুলনা করা যেতে পারে ধারালো ছুরির সঙ্গে। চিকিৎসকের হাতে  থাকলে সেটা জীবন বাঁচায় আর রংবাজদের হাতে থাকলে জীবন কেড়ে নেয়। যৌন প্রবৃত্তি হালাল উপায়ে ব্যবহৃত হলে  দুজন মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে,সাদা কালো জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার এই পৃথিবীতে  ভালোবাসা,স্নেহ,মায়া,মমতার সংসার গড়ে তোলে। যৌন প্রবৃত্তিতে শয়তানকে নাক গলাতে দিলে সে  ছলেবলে কৌশলে জাহান্নামের ওয়ান ওয়ে টিকিট ধরিয়ে দেবে
.
আল্লাহ্‌ (সুবঃ) এই সূরা আরাফের ২০ নম্বর আয়াতে বলেছেন,“ অতঃপর শয়তান তাদের দুজনকেই কুমন্ত্রনা দিল যেন সে তাদের নিজেদের (আদম এবং হাওয়া) লজ্জাস্থানসমূহ যা তাদের পরস্পরের কাছ থেকে গোপন করে রাখা হয়েছিল তা প্রকাশ করে দিতে পারে ...   
.
২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে
‘হে আদম সন্তানেরা শয়তান যেভাবে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে,তেমনি করে তোমাদেরকেও সে যেন প্রতারিত করতে না পারে,শয়তান তাদের উভয়ের দেহ থেকে তাদের পোশাক খুলে ফেলেছিল,যাতে করে তাদের উভয়ের গোপন স্থানসমূহ উভয়ের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে...
যে শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে, সে জেনেরাখুক, শয়তান অশ্লীল মন্দকাজের আদেশ দেয় (প্রলুব্ধ করে)
[
সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ২১]
.
শয়তান যেভাবে আমাদের আদি পিতামাতাকে প্রতারিত করে জাহান্নাম থেকে বের করেছে তেমনি আমাদেরকেও সে প্রতারিত করার চেষ্টা করে। আমাদের মধ্যে যিনা-ব্যাভিচার ,অশ্লীলতা,বেহায়াপনা,বিকৃত যৌনাচার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শয়তান আর তার দোসরেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বশক্তি দিয়ে।
.
 উনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন সবকিছু দেখতে শুরু করলো বিজ্ঞান নামক চশমার ভেতর থেকে তখন শয়তান আর তার দোসরদের দরকার ছিল এমন কিছু সায়েন্টিফিক থিওরির যেগুলো অশ্লীলতা,বেহায়াপনা, বিকৃত যৌনাচারগুলোর  পায়ের তলায় মাটি দাড় করিয়ে দেবে । সিগ্মন্ড ফ্রয়েড কিছু থিওরি দিয়েছে কিন্তু আসল (কু)কাজটা করে গেছে আলফ্রেড কিনসি।
.
১৯৪৮ সালে এই মহান ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ বের করে তার প্রথম বই ‘Sexual Behavior in the Human Male’ ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তার আরেকটি বই Sexual Behavior in the Human female
এই দুটি বই পাশ্চাত্যে ঝড় তোলে, যৌনতা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনে। পাশ্চাত্যের ইতিহাসের অন্য কোন বই বা রিপোর্ট পাশ্চাত্যকে এতোটা বদলে দেয়নি যা এই দুইটি বই দিয়েছিল। আধুনিক সেক্স এডুকেশান কিনসির এই দুইটি বইয়ের ওপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হচ্ছে। যৌনতা সম্পর্কে আধুনিক পশ্চিমা ধারণা একেবারে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত গড়ে উঠেছে আলফ্রেড কিনসির এই দুই বিখ্যাত ‘থিসিসের’ উপর ভিত্তি করে।
.
এই দুটি বইয়ে কিনসি এমন কিছু কথা বলে যা মানুষেরা আগে কখনোই শোনেনি । কিনসি দাবী করে যে শিশুরা জন্মগত থেকেই সেক্সুয়ালী এক্টিভ,সাত মাস বয়সী এক শিশু এবং এক বছরের নিচের আরো পাঁচজন শিশুকে সে মাস্টারবেট করতে দেখেছে। [Sex education as bullying, page 7 ]শিশুরা  বয়স্ক সঙ্গী/সঙ্গীনীদের সঙ্গে আনন্দদায়ক এবং উপকারী যৌনমিলন করতেই পারে এবং করা উচিত। [Kinsey,Sex and Fraud, page 3] পিতামাতার উচিত ৬-৭ বয়স থেকে শুরু করে শিশুদের মাস্টারবেট করানো। এবং মিলেমিশে একসঙ্গে মাস্টারবেট করা।
কিনসি দাবী করে ৩৭% পুরুষ  হোমোসেক্সুয়াল এক্সপেরিয়েন্সের সম্মুখীন হয় বয়ঃসন্ধিকাল থেকে বৃদ্ধ হবার সময়ের মধ্যে [Kinsey,Sex and Fraud, page 2]
.
 কিনসি দাবী করে মানব যৌনতার ওপর কারো কোন কর্তৃত্ব ফলানো চলবে না । তার যা মন চাইবে সে তাই করতে পারবে, এটাই স্বাভাবিক, সমকামিতা স্বাভাবিক,শিশুকাম,মাস্টারবেশন স্বাভাবিক,স্বাভাবিক সব ধরণের বিকৃত যৌনাচার, বরং নারী-পুরুষের স্বাভাবিক অন্তরঙ্গতাই অস্বাভাবিক। [Kinsey,Sex and Fraud, page 2]
.
পরবর্তীতে এই ‘মহান’ বিজ্ঞানীর কাজগুলো রিফিউটেশানের শিকার হয়েছে বিজ্ঞানীদের দ্বারাই। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন আলফ্রেড কিনসির দাবীগুলোর তেমন কোন সায়েন্টিফিক ভিত্তি নেয়, তার তথ্য উপাত্ত গুলো যথেষ্ট পরিমাণে গোঁজামিলে ভরপুর [Kinsey,Sex and Fraud, page 1]এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য অনেক সময় সাবজেক্টের ওপর চরম  যৌননির্যাতন চালানো হয়েছে, রেহায় দেওয়া হয়নি শিশুদেরকেও।
.
কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গিয়েছেই। কিনসি সব ধরণের বিকৃত যৌনাচারকে স্বাভাবিক করার যে দাবী তুলেছিল তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে দেরী করেনি শয়তান আর তার দোসরেরা। বস্তা বস্তা ডলার ঢেলে কিনসির ভুয়া দাবীগুলো  বিজ্ঞানের সহীহ শুদ্ধ পোশাক পরিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে পুরো বিশ্বের সাধারণ মানুষ জনের কাছে ক্রমাগত গুনগান গাওয়া হয়েছে সমকামিতার,শিশুকামের। সেক্স এডুকেশানের নামে বাচ্চাদেরকে ছোট থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে সমকামিতা,মাস্টারবেশন,এনাল সেক্সের মতো জঘন্য বিষয়গুলো। পশুকাম,শিশুকামকে স্বাভাবিক করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম, মুভি,সিরিয়াল,গল্প,উপন্যাসের মাধ্যমে সমকামীদেরকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে,পর্নমুভির মাধ্যমে হাতে কলমে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে সমকামিতা সহ সকল বিকৃত যৌনাচারেরBig Lie Theory’র আরেকটি জুতসই উদাহরণ। আর এ কাজে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে এবং করে চলছে Sexuality Information and Education Council of the United States (SIECUS), International Plant Parenthood Federation (IPPF), জাতিসংঘ, প্লেবয়ম্যাগাজিন, পর্ন ইন্ডাস্ট্রি, বিভিন্ন এনজিও ইত্যাদি । [এই সিরিজের পরবর্তী পর্বে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশা আল্লাহ্‌]
.
পড়ুন এই বইটিঃ https://goo.gl/AHVq5p
দেখুন এই ভিডিওটিঃ https://goo.gl/989ni9
.
পাশ্চাত্যের সেক্সিওলোজির পুরোটাই দাড়িয়ে আছে মিথ্যের ওপর।ইরাক,আফগানিস্তান,ইয়েমেনে ড্রোনে করে গনতন্ত্র,ব্যক্তিস্বাধীনতা,ফ্রিডোম অফ চয়েস ফেরি করে বেড়ানো পাশ্চাত্য কেন মিথ্যের ওপর দাড়িয়ে থাকা এই আইডিওলোজি গায়ের জোরে চাপিয়ে দিচ্ছে পুরো পৃথিবীর ওপর? অন্যের ব্যক্তিস্বাধীনতা,অন্যের ফ্রিডোম অফ চয়েসে নাক গলানোর অধিকার তাকে কে দিল? মুসলিম ভূখন্ডের অধিবাসীরা নিজেরাই ঠিক করে নিবে তারা সমকামিতা মেনে নিবে না বর্জন করবে, পাশ্চাত্যের গনতন্ত্রই তাদেরকে এই অধিকার দিয়েছে, পাশ্চাত্যের গনতন্ত্রই তাদেরকে এই অধিকার দিয়েছে তারা বেছে নিবে তাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি। তাহলে কেন পাশ্চাত্যে জোর করে ‘মুক্তি’-র পশ্চিমা সংজ্ঞা চাপিয়ে দিচ্ছে মুসলিমদের উপর? যারা ক্রমাগত চিন্তার স্বাধীনতার বুলি আওড়ায়, বৈচিত্র্যের স্তুতি গেয়ে বেড়ায়, যারা মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে সম্মান করার কথা বলে তারাই কেন পশ্চিমা লিবারেলিসমের আদর্শগুলোকে সারা পৃথিবীর মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়? যা কিছু পশ্চিমা লিবারেলিসমের ছকের ভেতর পড়ে তা সভ্যতা আর যা কিছু এর বাইরে তার সবই পশ্চাৎপদতা কীভাবে তারা ই ঔদ্ধত্য ভরা দাবি করে?
https://goo.gl/TtXpFh

ইনশাআল্লাহ্‌ এই সিরিজে আমরা পাশ্চাত্যের সেক্সিওলোজির শিকড় ধরে টান দেবার চেষ্টা করব। আমরা দেখব কিভাবে পাশ্চাত্য গায়ের জোরে সমকামিতাকে স্বাস্থ্যকর হিসেবে প্রমান করে চলেছে,কিভাবে সেক্স এডুকেশানের মাধ্যমে কিন্ডারগার্ডেনের বাচ্চাদেরকেও সমকামিতা,এনালসেক্স,ওরাল সেক্স, পেডেরাস্টি, মাস্টারবেশনের দীক্ষা দিচ্ছে, কিভাবে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে,বাংলাদেশে এনজিও ওয়ালারা সমকামিতার প্রসার ঘটিয়ে চলেছে, পাশ্চাত্যের চেপে রাখা শিশু আর নারী নির্যাতনের ইতিহাস আমরা আলোচনা করব, আমরা মুখোশ খুলে দেবার চেষ্টা করব  কিছু দেশ,কিছু ওরগানাইজেশান,কিছু ব্যক্তির,কিছু কোকোনাট শায়খদের যারা এই পৃথিবীটাকে আপনার এবং আপনার সন্তানের জন্য বসবাসের অনুপোযুক্ত করে তুলছে। আপনি আমন্ত্রিত
ধন্যবাদ । 

ডাওনলোডঃ
১) Kinsey,Sex and Fraud -https://goo.gl/Jy99ze
২) Sex Education as Bullying- https://goo.gl/AHVq5p